January 18, 2014

পাতানো নির্বাচন এবং এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রশ্ন

১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ তার সব কর্মকাণ্ডে জনগণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করেছে। অথচ সেই দলটি নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচন হাইজ্যাক করেছে এবং শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের ভোটের অধিকারকে অস্বীকার করেছে। এ নির্বাচনে তথাকথিত বিজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে- ৩০০টির মধ্যে ১৫৩ আসনে প্রার্থী জয়ী হওয়ার জন্য একটি ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি। এটা যদি পূর্বনির্ধারিত না হয় তাহলে কি? এসব এ নির্বাচনকে পাতানো এবং ফলাফলকে বল প্রয়োগের বিজয়ের খেতাব এনে দিয়েছে। এরপর নতুন সরকার গঠনের বিষয়টি আসে, যা যে কোন নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যে। এ সরকারও গঠন হয়েছে ভোটারদের কোন ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়া। আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা যদি আমরা বিশ্বাস করি তবে গণতন্ত্র হচ্ছে, জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। তাহলে ৫ই জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের সরকার নয়, জনগণের দ্বারা গঠিতও নয়। এ সরকার  জনগণের জন্য কিনা তাও কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারবে। শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেননি। যদিও তিনি সব সময় দাবি করে থাকেন গণতন্ত্রের জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিতকতার নামে তিনি এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী যে নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট পড়েছে ৩৯ শতাংশ। যা গত নির্বাচনে ৩০০ আসনে পড়া ৮৭ শতাংশ ভোটের তুলনায় অনেক কম। এবারের নির্বাচনে ভোট পড়ার যে হারের কথা বলা হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটের দিন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় যে চিত্র দেখা গেছে তাতে ভোটের হার কিছুতেই ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি হতে পারে না।
৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাওয়া। গত দুই যুগ ধরে তাদের যে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, প্রতি ৫ বছর পর পর তারা কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের মত প্রকাশ করতে পারবেন। এখন এ বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। এটাও প্রমাণ হয়েছে, আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অধীনে কোন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি-ই হোক। এখন আমরা একটি মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন কি এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি। সমালোচক হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রের বন্ধু হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে তার হাতে থাকা অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে সতর্ক করছি। লর্ড অ্যাকটিন এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়। আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- নির্বাহী বিভাগ, সংসদ এবং বিচার বিভাগ। আজকের দিনে শেখ হাসিনা প্রশ্নাতীতভাবে এবং কার্যকরভাবে দু’টি স্তম্ভ নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণভাবে রীতি অনুযায়ীই আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইন প্রণয়নকারী বিভাগ-সংসদের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিরাট প্রভাব রয়েছে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনের পর নতুন অগ্রগতিও হয়েছে। এমনকি এখন বিরোধী দলও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিরোধী দলের একটি অংশ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে, আরেকটি অংশ রয়েছে বিরোধী দলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। আমরা সবাই জানি, কিভাবে বিরোধীদলীয় নেতা তৈরি করা হয়েছে। এবং তথাকথিত বিরোধীদল কিভাবে সরকারের মন্ত্রিসভায় আরও স্থান পাওয়ার জন্য দরকষাকষি করছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদের ওপরও প্রধানমন্ত্রীর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি থাকে বিচার বিভাগ। ঐতিহ্যগতভাবেই বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে থাকে। উচ্চ আদালতের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না। আমরা এখন এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছি যেখানে সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভারসাম্য নেই। সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাসের ওপরই সুশাসন নির্ভর করে। রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে গেলে তা সরকার ব্যবস্থার জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। সরকার ব্যবস্থায় ভারসাম্য নীতির অভাব আরও অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে। সাধারণ পরিস্থিতিতে কোন দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়কর হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপের ইতিহাস রয়েছে। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিয়ন্ত্রণাধীন বিরোধী দল, ভারসাম্যহীন ক্ষমতার অধিকারী নেতার আবির্ভাব এবং এমন কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা যা তাকে দায়বদ্ধ করতে পারে, এ অবস্থায় লর্ড অ্যাকটিনের ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। এটা রেকর্ডে থাক যে, সর্বপ্রথম সতর্কঘণ্টা আমরাই বাজিয়েছিলাম।
 
(১৭ই জানুয়ারি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor