April 18, 2011

হু ইজ তোফায়েল!


জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে পরিবার-পরিজনসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে খুনিচক্র, বীভৎস উল্লাসনৃত্যেই মেতে ওঠেনি, আওয়ামী লীগ-মুজিবের অনুগত নেতাদের দমনের নির্দয় নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিল। বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদকে শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এনে রাখা হয়েছিল। ৩ সেপ্টেম্বর তাদের ধরে নেয় খুনি সেনা সদস্যরা। ৬ তারিখ ছিল ৩ রোজা। ইফতার শেষে এবাদত-বন্দেগি, এশা ও তারাবির নামাজ পড়ে তারা ঘুমাতে যান। তখন কলোকাপড় পরা সশস্ত্র খুনিচক্রের সদস্যরা এসে প্রবেশ করে হাঁক দিল, হু ইজ তোফায়েল! আগন্তুকদের ভাবভঙ্গি, চাহনি, কঠোর ডাক শুনে সবাই ভাবলেন সময় বোধহয় শেষ। বঙ্গবন্ধুর আদরের দুলাল তোফায়েলকে বুঝি এবার মেরেই ফেলবে। তোফায়েল ভাবলেন পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে মেরে ফেলবে। তিনি তাই ওজু করলেন। ওরা তাকে চোখ বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে গেল। তারপর চেয়ারের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালাল। ১৫ আগস্ট তারা বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ডে গুলি চালিয়েছিল। এবার ইতিহাসেরই এক বংশীবাদক তোফায়েলকে হাতের নাগালে পেয়ে যেন হিংস হয়ে উঠেছিল। তোফায়েলকে মারছে আর জানতে চাইছে কী খবর আছে তার কাছে? বঙ্গবন্ধুর টাকা-পয়সা কোথায়? কোথায় রক্ষীবাহিনীর জন্য আসা অস্ত্র? আরও কত কি। তারপর রোমহর্ষক ফিল্মি দৃশ্যকে হার মানানো মানসিক নির্যাতনে তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। শারীরিক নির্যাতনে শরীর ক্ষতবিক্ষত করা হয়। তারা ঊনসত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত ইতিহাসের ওপর কষে বুটের লাথি চালিয়েছে। ওরা পারে বলে হিমালয়ের মতো উচ্চতা আর সাগরের মতো বিশাল হৃদয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে এতিম করেছে। তারা সেদিন নারী-শিশু হত্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের চোখে রক্ত নেই। হৃদয় বলে কোনো অনুভূতি নেই। বিবেক বলে দেহের ভেতর কিছু নেই। মাথায় শুধুই ছিল নিষ্ঠুরতা। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পিতৃস্নেহে ধন্য তোফায়েল মুখ না খোলায় তাকে আধমরা করে এনে ফেলে রাখে শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। আজকের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রবীণ জননেতা আবদুর রাজ্জাক গভীর স্নেহে তাকে সেবা করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার আগে তাকে দফায় দফায় নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলিয়ে নানা অপপ্রচার চালাতে চেয়েছে।

তার আগে ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা করার পর এই নেতারা ছিলেন গৃহবন্দী। ১৭ আগস্ট তাকে এবং জিল্লুর রহমানকে চোখ বেঁধে নেওয়া হয় বঙ্গভবনে। খুনি মোশতাক সরকারকে সমর্থন না দেওয়ায় তোফায়েলকে চোখ বেঁধে নেওয়া হয় রেডিও স্টেশনে আটকে নির্যাতন করতে। মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী সেদিন মোশতাকের সামরিক সচিব থাকাকালে তোফায়েলকে মুক্ত করে দেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পুলিশের সাবেক আইজি মরহুম ই এ চৌধুরীকে পাঠিয়ে। ই এ চৌধুরীও স্বস্তি পান। তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে ৩ সেপ্টেম্বর তাদের গ্রেফতার করে নেওয়া হয়।

এই সেই তোফায়েল আহমেদ যাকে একদিন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগি্নমুখর ছাত্রসমাজ ডাকসু নায়কের বরমাল্য পরিয়েছিল। এ সেই তোফায়েল যাকে ষাটের দশকের গৌরবময় ছাত্রলীগ দিয়েছিল সভাপতির দায়িত্ব। তোফায়েল সেই মেধাবী তেজস্বী ছাত্রনেতা যার হাতের উষ্ণ আলিঙ্গন পেতে ছাত্রসমাজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ক্যাম্পাস মাতানো আরেক ছাত্রলীগ নেতা। ফজলুল হক হলের ভিপি-জিএস ছিলেন। তোফায়েলের ভিপি হওয়ার পেছনে তার ভূমিকাও রয়েছে। তিনি নানা আড্ডায় মন খুলে বলেন, তোফায়েলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না জানলে চেনা যাবে না। তখনই তিনি রুচিবান, পরিপাটি মানুষ। জহুরুল হক হলে (ইকবাল হল) তার রুম ছিল আলাদা। এ সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীরা কখনো কাছে কখনো দূরে দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে দেখতেন ভুবনভোলানো রোমান্টিক হাসির তোফায়েলকে। ভালোবেসে ডাকতেন উত্তম কুমার বলে। তরুণীহৃদয়ের ঝড় তোলা রাজনীতির মঞ্চের তোফায়েলের জন্য একদিন বটতলা-পল্টন জেগে থাকত। সেই তোফায়েলের বাঁশির সুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তাল ঢেউ ছড়িয়েছে বাংলায়। আগুন জ্বলেছে দাবানলের মতো। আগরতলা মামলায় বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার খায়েশ পূরণ হলো না। ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিল। গণঅভ্যুত্থান হলো। আইয়ুবের পতন হলো। বিচারক পালালেন। তোফায়েলের মাথায় উঠল নায়কের তাজ। বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া সংবর্ধনায় তোফায়েল ছাত্রজনতার পক্ষে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দিলেন। বাঙালির নেতাকে তার পর থেকে জাতি প্রাণ উজাড় করে ডাকে বঙ্গবন্ধু বলে। বঙ্গবন্ধু তোফায়েলকে '৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে বিজয়ী করান। সারা দেশে সফরে নিয়ে বড় করে তুলে ধরেন। এ সেই তোফায়েল, যাকে নিয়ে জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখলেও তার দল মুজিবহীন বাংলায় স্বপ্ন দেখেনি আর। অন্তহীন দহনে দগ্ধ হচ্ছেন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছেন। তাই হয়তো একদিন অভিমানী তোফায়েল বলেছিলেন, আমার অতীত আছে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই। তাই অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, আল্লাহভীরু তোফায়েলের কথায় একমত হননি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বলেছেন, আল্লাহই জানেন কার কপালে কী রেখেছেন। কার বর্তমান ভবিষ্যৎ আছে, কার নেই। এ সেই তোফায়েল যাকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরেই তার রাজনৈতিক সচিব করে বিশ্ববরেণ্য নেতাদের সানি্নধ্য দিয়েছেন। দিয়েছেন গভীর স্নেহ, মমতা। তাই বনানীর বাড়িতে লাইব্রেরির চেয়ারে যেখানে বসেন তার মাথার ওপরে থাকে ইতিহাসের মহানায়কের সঙ্গে রাজনীতির বংশীবাদক তোফায়েলের উষ্ণ আলিঙ্গনের এক মধুর ছবি। যে ছবির দিকে আঙুল তুলে তোফায়েল ওয়ান-ইলেভেনে এক সামরিক কর্মকর্তাকে অবাক করে বলেছিলেন, 'যাই করি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারব না।' '৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তোফায়েলই সেই নেতা যাকে বারবার কারাগারে থাকতে হয়েছে। তার মেধা, বিচক্ষণতা, পড়াশোনা, বাগ্মিতা, আশরাফ-আখলাক মানুষকে মুগ্ধ করে। মানুষকে সম্মান করা, মেহমানকে আপ্যায়ন করা, গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া তার অলঙ্কার। তার বক্তৃতার শব্দে শব্দে, বাক্যে বাক্যে রাজনীতি খেলা করে কিন্তু শত্রুর প্রতিও আক্রোশ বা অশালীন আক্রমণের কোনো ছায়া পড়ে না। অদ্ভুত! বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে, তার সঙ্গে দুনিয়া ঘুরে শিখেছেন অনেক কিছু। তিনি ইতিহাসের ঘটনার দিন-তারিখ বলে দেওয়ার এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া! টেলিফোন নম্বর মনে রাখার জন্য এক চলমান এক্সচেঞ্জ। '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান নিয়ে গিয়ে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। আর এদিকে সামরিক আদালত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহসী ভূমিকা নেওয়া পিপলসের সম্পাদক আবিদুর রহমানের সঙ্গে তোফায়েল আহমেদেরও ১৪ বছর কারাদণ্ড, ১৫টি বেত্রাঘাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের দণ্ড দেয়। '৭৫ সালের পর জিয়ার সেনাশাসনেও কারাবন্দী তোফায়েলের ব্যাংকে থাকা ২৮ হাজার টাকা, অসহায় স্ত্রীর নামে থাকা আট হাজার ও একমাত্র শিশুকন্যার নামে থাকা চার হাজার মোট ৩৪ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছিল। '৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ২৫ হাজার টাকা দিলে চার হাজার বেঁচে যায়। সে টাকাও ইয়াহিয়া খান জব্দ করেছিল। যুদ্ধের পর তিনি ফেরত পান। '৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পিপলস সম্পাদক আবিদুর রহমানকেও জাতীয় চার নেতার সঙ্গে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। সরকার এ ধরনের মানুষকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় না! রাজনীতি তোফায়েলকে নির্বাসিত করলেই কি তার নির্বাসন হয়ে যাবে? হয়তো না। আর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের তোফায়েলরা রাজনীতির অলঙ্কার। অলঙ্কার ছাড়া কি রাজনীতির জৌলুস ফিরে আসে? আর ইতিহাস? যদি ছেলে ভুলানো না হয় তবে তো নায়কের সামনে বারবার তার নাম আসে। বিনয়ী তোফায়েলের কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। ছাত্ররাজনীতির উত্থানে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাকদের কথা মন বড় করেই বলেন। যারা তার সানি্নধ্যে যান, দেখেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে বলতে তিনি বহমান নদীর মতোই যেন কাঁদেন। এ কান্না শেষ হয় না। এ কান্না যে স্নেহশীল পিতার জন্য এতিম সন্তানের কান্না! অভিমানী তোফায়েল পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদশে সংগ্রামের সিঁড়ি, পথেই হাঁটেননি! আপসহীন মানুষকে বারবার অপমান, নির্যাতন, মানসিক পীড়ন, জেল-জুলুমের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। বুকভরা কান্না-কষ্ট-বেদনা নিয়ে তিনি কোথায়ইবা যাবেন। যেতে পারেন কিন্তু কেন যাবেন। বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো যেতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া তিনি কোথায়ইবা যেতে পারেন। চিরবিদায় নিলেও উত্তম কুমার এখনো মহানায়ক! তোফায়েলের ঠাঁই রাজনীতি হোক বা না হোক, ইতিহাসে তিনিই হবেন ৬৯'র বংশীবাদক, নায়ক।
-পীর হাবিবুর রহমান

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor