টিভি মিডিয়ার দুই প্রিয় মুখ, তারকা-দম্পতি হিসেবে পরিচিত, সাগর ও রুনি আর নেই। শুক্রবার গভীর রাতে অজ্ঞাত ঘাতকদের নৃশংসতার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন তারা। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে ঘটে এ রহস্যময় হত্যাকাণ্ড। সাগর-রুনি দম্পতির শিশুপুত্র রক্ষা পেয়েছে খুনিদের আক্রোশ থেকে। পুলিশ বলছে, এ হত্যা পরিকল্পিত। খুনিরা নিহতদের পরিচিত। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের ভাড়া বাসা থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি’র রক্তাক্ত মৃতদেহ গতকাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাগর-রুনি দম্পতির ৫ বছরের একমাত্র সন্তান মাহিদ সরওয়ার মেঘ ঘটনাচক্রের খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
পুলিশ বলছে, খুনিরা নিহতদের কারও সঙ্গেই বাসায় ঢুকেছিল। এ ঘটনায় বাড়ির তিনজন নিরাপত্তারক্ষীকে আটক করা হয়েছে। নিহত রুনির দুই ভাইকে ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
গতকাল দিনের শুরুতেই এ মর্মান্তিক খবর শুনে সেখানে ছুটে যান বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। পরে ঘটনাস্থলে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, আইজিপি, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, মহানগর পুলিশ কমিশনার। পশ্চিম রাজাবাজারে ৫৮/এ/২ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাঁচতলা ভবনটির পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে ছেলেকে নিয়ে থাকতেন সাগর-রুনি দম্পতি। গতকাল সকালে বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায় শ’ শ’ উৎসুক মানুষের ভিড়। পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচতলার এ-৪ ফ্ল্যাটে থাকতেন সাগর-রুনি দম্পতি। সেখানে এখন বিলাপ করছেন নিহতের শোকাতুর স্বজনরা। সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে। ফ্ল্যাটে ৩টি শোবার ঘর। মাঝের রুমে থাকতেন সাগর-রুনি। ওই রুমে ঢুকে দেখা যায়, মেঝেতে রুনির রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। তার পেটে ও গলায় গভীর কাটা দাগ। সাগরের লাশ বিছানায় আড়াআড়িভাবে রাখা। গায়ে জামা নেই। পরনে জিন্সপ্যান্ট। পায়ের দিকে একটু গোটানো। তার শরীরে ধারালো অস্ত্রের অসংখ্য চিহ্ন। শ্বাসনালী কেটে দেয়া। হাত-পা বাঁধা। পুরো ঘর রক্তভেজা। ঘরের একদিকে একটি ওয়্যারড্রোব। তার ওপর একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার। ড্রয়ার খোলা। তাতে একটি দামি মোবাইল ফোনসেট রাখা। ঘরে এক কোণে আলমারির দরজা খোলা। সেখান থেকে কয়েকটি কাপড় বেরিয়ে পড়েছে। ঘরের মেঝেতে দু’টি স্বর্ণালঙ্কারের খালি বাক্স পড়ে আছে। রুনি’র মা নুরুন নাহার মির্জা নাতির ফোন পেয়ে গতকাল প্রথম ফ্ল্যাটে যান। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি এসে তাদের রক্তাক্ত দেহ দেখে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। চিৎকার করতে করতে আমি আমার ছেলেদের ফোন করি। ওরা এসে রুনির সহকর্মীদের খবর দেয়। পরে পুলিশ আসে। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আমার নাতি মেঘ ফোন করে বলে- নানু, আম্মু-আব্বুকে মেরে ফেলেছে। তুমি এসো। আমি তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাসায় যাই। বাসার দরজা খুলে দেয় মেঘ। তাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি সাগর-রুনির লাশ। তিনি বলেন, আমাদের বাসা কাছে হওয়ার কারণে মেঘ আমার কাছেই থাকে। সাগর বা রুনি যে আগে অফিস থেকে ফেরে সে গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। শুক্রবার রুনি রাত ৯টার দিকে অফিস থেকে ফিরে মেঘকে নিয়ে আসে। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘ রাজাবাজারের উইলিয়াম কেরি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কেজি ওয়ানের ছাত্র। ঘটনার সময় সে বাসাতেই ছিল। তবে সে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারছে না। শুধু বলছে, মা-বাবাকে দু’জন মানুষ মেরে ফেলেছে। ওরা আমাকে পাশের ঘরে আটকে রেখেছিল। পরে কখন দরজা খুলে দেয় জানি না। বেরিয়ে দেখি বাবা-মা মেঝেতে শুয়ে আছে। ঘরে অনেক রক্ত। রুনি’র বড় ভাই নওশাদ আলম বলেন, আমি খুব ভোরে অফিসে যাই। সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হই। পথেই মোবাইল ফোন আসে। ঘটনা শুনে দ্রুত এ ফ্ল্যাটে এসে দেখি সব শেষ। নওশাদ আলমের স্ত্রী পারভিন যুথি বলেন, খবর পাওয়ার পর আমরা ওই বাসায় গিয়ে দেখি দরজা খোলা। মেঘ আমাদের বলেছে, দু’জন লোক তার বাবা-মাকে মেরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। সাগর-রুনির ফ্ল্যাটের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে বাসায় ফিরি। তবে রাতে ওদের ফ্ল্যাট থেকে তেমন কোন শব্দ পাইনি। সকালে হৈচৈ শুনে বের হয়েছি। সাগর-রুনির ফ্ল্যাটের ঠিক নিচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তৌফিকা রহমান জানান, রাত ২টার দিকে তিনি ঘুমাতে গিয়েছেন। কিন্তু তেমন কোন শব্দ তিনি পাননি। তবে রাত ২টা বা শোয়া ২টার দিকে বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামার শব্দ পেয়েছিলেন। রাতে ওই ভবনে দায়িত্ব পালন করছিলেন নিরাপত্তারক্ষী পলাশ রুদ্র পাল। তিনি বলেন, রাত ২টার দিকে সাগর সাহেব বাসায় ফিরেছেন। এর আগে কখন রুনি ম্যাডাম বাসায় ঢুকেছেন তা আমি দেখিনি। তাদের বাসায় অপরিচিত কেউ আসেনি বা যায়নি। অতিথি রেজিস্ট্রার বইয়েও তাদের ফ্ল্যাটে কোন অতিথি যাওয়ার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পলাশ বলেন, ফ্ল্যাট মালিক এসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুন্নবী সাহেব ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আমাকে ফোন করে বলেন, কোথা থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কোন ফ্ল্যাট থেকে শব্দটা আসছে দেখ তো। আমি এদিক ওদিকে দেখে তেমন কোন শব্দ না পেয়ে তাকে বলি হয়তো বাইরের ফ্ল্যাটে কোন বাচ্চা কাঁদছে।মাছরাঙা টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, রাত পৌনে ২টা পর্যন্ত অফিসে কাজ করেছেন সাগর। এরপর বাসায় ফেরেন। এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জিএম তসলিম জানান, গতকাল রুনির মর্নিং ডিউটি ছিল। ডিউটি শেষে তিনি সাড়ে ৪টার দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে যান। শেরেবাংলানগর থানার ওসি (তদন্ত) আহমদ কবির বলেন, রুনি’র সঙ্গেই হয়তো খুনিরা ঢুকেছিল। এ কারণেই রেজিস্ট্রার খাতায় তাদের নাম এন্ট্রি করা হয়নি। অথবা ফ্ল্যাটে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল। যারা নিরাপত্তারক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে খুনিদের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, এমনও হতে পারে রাতে রুনি ফেরার পরও সাগরের জন্য অপেক্ষা করেছে খুনিরা। গভীর রাতে সাগর ফিরলে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে। তখন রুনি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকেও হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, রুনির এক ভাই ফ্ল্যাটে রাত ১০টা পর্যন্ত ছিল- আমাদের কাছে এমন তথ্য এসেছে। তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার ইমাম হোসেন বলেন, আমাদের ধারণা খুনিরা বিষয়টিকে ডাকাতি বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। এজন্য তারা রান্নাঘরের গ্রিল কেটে একটি ছোট ফাঁক তৈরি করে। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, সেখান দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কারও বের হওয়া সম্ভব নয়। হত্যাকারী স্বজনদের কেউ কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করছি। ইতিমধ্যে নিরাপত্তারক্ষীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। স্বজনদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রুনির দুই ভাই নওশাদ আলম ও নওদিশ আলমকে ডিবি অফিসে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাহবুবুর রহমান। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়া-উল আহসান বলেন, আমাদের ধারণা ঘাতকরা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। খুনিরা তাদের পূর্বপরিচিত ছিল। শেষ রাতের দিকে তাদের হত্যা করা হয়েছে, এ কারণে সকাল ১১টায়ও লাশের শরীর গরম ছিল। তাজা রক্ত বের হচ্ছিল। তিনি বলেন, এটি কোন ডাকাতির ঘটনা নয়। কারণ ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। ওদিকে দু’টি মরদেহের ময়নাতদন্তের পর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে খুনি অপেশাদার। নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলা কেটে দেয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, দু’জনের শরীরেই ছুরি ও ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আঘাতের ধরন দেখে আমাদের মনে হয়েছে, খুনি অপেশাদার কেউ। কারণ পেশাদার হলে খুনি জানতো কোথায় আঘাত করলে মৃত্যু নিশ্চিত করা যাবে। সাগরের দেহে ১৯টি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানান তিনি।
জানাজা: গতকাল দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে এই সাংবাদিক দম্পতির মরদেহ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের প্রথম জানাজায় অংশ নেন এই দুই সাংবাদিকের সহকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও স্বজনরা। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের শিরিন আখতারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ সময় সাগর-রুনির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। পরে রাতেই তাদের আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
No comments:
Post a Comment