March 11, 2014

আত্মঘাতী আওয়ামী লীগ

ফজলুর রহমান ও আলী আসিফ শাওন
দেশজুড়ে দফায়-দফায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ধারাবাহিক সন্ত্রাস তো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপজেলাকেন্দ্রিক নির্বাচনি আত্মহানাহানি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত রূপ দিয়েছে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। এ যুদ্ধে চাপাতি থেকে রাইফেল পর্যন্ত সব রকম মারণাস্ত্রই ব্যবহূত হচ্ছে। বিএনপি-জামাতের পেট্রলবোমায় নয়, আওয়ামী লীগ এখন আওয়ামী লীগের  গুলিতেই রক্তাক্ত।
গত শনিবার গাজীপুরের শ্রীপুর ও চাঁদপুরের কচুয়া এবং শুক্রবার ভোলার দৌলতখান উপজেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে শতাধিক কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু শ্রীপুরেই গুলিবিদ্ধ হন ২৩ জন। ওই ঘটনায় আহত ছাত্রলীগনেতা আল আমিন মারা গেছেন সোমবার রাতে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে। শনিবারের সংঘর্ষকালে প্রায় ৪ ঘণ্টা অচল থাকে শ্রীপুর পৌরশহর। নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে চলা এ তাণ্ডবে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একই দিন চাঁদপুরের কচুয়ায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের উপস্থিতিতে দুই উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২০ জন এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় ভোলার দৌলতখানে একই দলের দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন।
দখল, চাঁদাবাজি আর খুনোখুনি গত মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। গত মেয়াদে ছাত্রলীগের বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ড ও যুবলীগের টেন্ডারবাজিতে চট্টগ্রামে শিশু নিহত হওয়ার ঘটনা দুটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল। আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করেছে, কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না সংগঠন দুটির মধ্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে থানা ভাঙচুরের ঘটনাও শুরু হয়েছে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট আর আওয়ামী লীগের নৌকা ফুটো করতে ছাত্রলীগ-যুবলীগই যথেষ্ট।
৯ মার্চ নড়াইলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা টেন্ডার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। ১২ লাখ টাকার টেন্ডার জমা দিতে গেলে ঠিকাদার সাজ্জাদ হোসেন ও বাবুলকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যুবলীগকর্মী মহিদ, নাছিম বিল্লাহ, বাদশা, হাসানসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ তাদের মারধর করে টেন্ডার ছিনিয়ে নেয়। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ আলীসহ স্থানীয় নেতারা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন। একই দিন দুপুরে সাভারে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ডিইপিজেডের বিদেশি মালিকানাধীন একটি কারখানার ঝুট ব্যবসায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অস্ত্র ও দুই সহযোগীসহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগনেতা সোহেল পারভেজ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে আটক হন। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গতকাল যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে সোহেলকে। ৫ মার্চ নোয়াখালীর কবিরহাট থানায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৪০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় পুলিশসহ অন্তত ৬ জন আহত হয়। কাছাকাছি সময়ে বরিশালের গৌরনদীতে হাটের ইজারা নিয়ে সংঘর্ষ বাধে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে। ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে গোলপাহাড় ও মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের দুগ্রুপের মধ্যে দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় একটি মার্কেটে চাঁদাবাজির জের ধরে ঘটনাটি ঘটে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় বিজি প্রেসের স্টেশনারি ভবনে কোটি টাকার টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সম্পাদক সিদ্দিকী কাজল ও তার সমর্থকদের নামে টেন্ডারবক্স জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। স্টেশনারি ভবনে দরপত্র জমা দেওয়ার দিন স্থানীয় এক প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে কাজল ও তার সমর্থকরা প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের টেন্ডার জমা দিতে বাধার সৃষ্টি করেন। প্রতিপক্ষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও অমীমাংসিত রয়েছে কোটি টাকার টেন্ডার প্রক্রিয়াটি। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়াও শিক্ষক পেটানো, হলে মেয়ে নিয়ে রাত কাটানো, চাঁদাবাজি, মারামারির ঘটনাও ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। ২৫ জানুয়ারি সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক দিনের মাথায় সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় পুরনো গাড়ি নিলামের জের ধরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা থানার ওসির রুম ভাঙচুর করেন। মন্ত্রীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-এমপিদের সামনেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, শীর্ষনেতাদের গাফিলতির কারণেই সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, ২ বছরমেয়াদি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৩ সালের ১২ জুলাই। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির শীর্ষনেতারা এখন সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে আবার সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে রাজনীতি ছেড়েছেন। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকও হয় না নিয়মিত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও আঞ্চলিকতার রেশ ধরে বেশ কয়েকটি গ্রুপও সৃষ্টি হয়েছে ছাত্রলীগে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ কমেছে, বেড়েছে দূরত্ব। তা ছাড়া দলীয় এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কথায় জেলা কমিটি ও থানা কমিটি দেওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট থানা ও জেলায় বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটলে তেমন একটা কিছু করার থাকে না।
যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে চিহ্নিত চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ ও টেন্ডারবাজদের পদ দেওয়ার ফলে সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা। যদিও কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, কোনও সন্ত্রাসী, অস্ত্রবাজকে যুবলীগ পালন করে না। তারপরও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে সঙ্গে-সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, সব ঘটনাতেই আমরা সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। অন্যায়কে আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি না। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একজনকে বহিষ্কার করেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জনকে বহিষ্কার করেছি, খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক খুনোখুনি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, প্রথমত আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। তার সঙ্গে ১৪ দল ও জাতীয় পার্টি মিলে আকার-পরিসর আরও বেড়েছে। তাই যে-কোনও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৪ দল, এমনকী মহাজোটও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দুই-এক জায়গায় সংঘর্ষও হচ্ছে। তবে সেই সংঘর্ষ, সংঘাত প্রাণঘাতী হলেই বিপদ। আর তা যেন সরকার ও দলের জন্য আত্মঘাতী না হয়ে যায়, সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। 
(আমাদের সময়, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০১৪)

January 23, 2014

অন্তরালে মহানায়িকা


মহানায়িকা সুচিত্রা সেন গত শুক্রবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। ৮২ বছর বয়সী কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী জীবনের শেষ দিনগুলো নীরবে-নিভৃতেই পার করেছেন। তাই তাকে নিভৃতবাসিনী হিসেবেও আখ্যা দেয়া যায়। সুচিত্রা সেন ছিলেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের স্বপ্নরানী। মায়াবী মুখশ্রী, ভুবনমোহিনী হাসি, মনকাড়া নেত্রযুগল, অনিন্দ্যসুন্দর দেহাবয়ব ও অভিনয় ক্যারিশমার কারণে 'মহানায়িকা' খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ষাট থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে জন-অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা। সেই অন্তরাল থেকে চির-অন্তরালে চলে গেছেন জনগণমননন্দিতা এই চিত্রনায়িকা।

তার জন্ম বাংলাদেশের পাবনায়। করুণাময় দাশগুপ্ত ও ইন্দিরা দাশগুপ্তার মেজ মেয়ে রমা দাশগুপ্তা (সুচিত্রা সেন)। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেন এক পরমাসুন্দরী কন্যা। শিশুকন্যাটিকে আত্মীয়স্বজনরা আদর করে কৃষ্ণা নামে ডাকতেন। করুণাময় ও ইন্দিরা কিন্তু তাদের মেয়েকে রমা নামেই সম্বোধন করতেন।
স্কুলজীবন
কর্মসূত্রে পাবনায় থাকতেন করুণাময় বাবু। পাবনা গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি করার সময় অ্যাডমিশন ফর্মে মেয়ের নাম রমা দাশগুপ্তা লেখেন তিনি। শৈশব-কৈশোর পাবনাতেই কেটেছে সুচিত্রার। পাবনায় ছোট্ট রমাকে দেখে এক নাগা সন্ন্যাসী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে মেয়েটি সুলক্ষণা। এই মেয়ে বড় হয়ে খুব নাম করবে। সবাই ওর প্রশংসা করবে। অর্থ-যশ সবকিছুই পাবে।

ছোটবেলায় সুচিত্রা সেনের হাতের লেখা বেশ সুন্দর ছিল। শাড়ি ছিল স্কুল ইউনিফর্ম। শাড়ি তিনি নিখুঁতভাবে পরতেন। চুল সুন্দর করে কলাবেণি করতেন। আসলে ওই বয়স থেকেই রমার ড্রেস সেন্স ছিল অসাধারণ। তিনি এত সুন্দর করে সাজতেন যে ছেলেরা তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
 
প্রথম ছবি
১৯৪৭ সালে আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। রূপশ্রী স্টুডিওতে 'সঙ্কেত' নামে একটি ছবির জন্য প্রথম স্ক্রিন-টেস্ট করেন তিনি। শ্বশুর আদিনাথ সেনের অনুমতি নিয়েই অভিনয় জগতে পা রাখেন রমা।
রমা থেকে সুচিত্রা
১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের 'সাত নম্বর কয়েদি' সুচিত্রা সেনের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। সুকুমার বাবুর সহকারী ছিলেন নীতিশ রায়। তিনিই রমার নাম রাখেন সুচিত্রা। তবে প্রথম যে ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন তার নাম 'শেষ কোথায়'। কিছু দিন কাজ করার পর শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই অসমাপ্ত ছবির সুবাদেই তিনি নীরেন লাহিড়ীর 'কাজরী' ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। এর সূত্র ধরেই মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতেও অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি।
সুচিত্রা-উত্তম ২৮
সর্বমোট ২৮টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেন সুচিত্রা-উত্তম জুটি। তাদের অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে 'সাড়ে চুয়াত্তর', 'ওরা থাকে ওধারে', 'মরণের পরে', 'প্রিয় বান্ধবী', 'অগি্নপরীক্ষা', 'শাপমোচন', 'সাগরিকা', 'শিল্পী', 'হারানো সুর', 'চন্দ্রনাথ', 'পথে হল দেরি' (প্রথম বাংলা রঙিন ছবি), 'জীবন তৃষ্ণা', 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত', 'ইন্দ্রাণী', 'সূর্যতোরণ', 'চাওয়া পাওয়া', 'সপ্তপদী', 'গৃহদাহ', 'আলো আমার আলো' প্রভৃতি।
দেবদাসে পার্বতী
১৯৫৪ সালে বিমল রায় শরৎচন্দ্রের 'দেবদাস' হিন্দিতে নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। নাম ভূমিকায় দিলীপ কুমারকে নির্বাচন করেন তিনি। চন্দ্রমুখীর চরিত্রে ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। পার্বতীর ভূমিকায় প্রথমে মীনা কুমারীকে নেয়ার কথা ভাবেন বিমল বাবু। কিন্তু মীনা কুমারী সময় দিতে না পারায় মধুবালার কথা ভাবা হয়। এদিকে দিলীপ কুমারের সঙ্গে মধুবালার মনোমালিন্য ঘটায় শেষ পর্যন্ত ভাগ্নেবউ সুচিত্রার কথা মাথায় আসে বিমল বাবুর। বিমল রায় আদিনাথ সেনের শ্যালক।
যখন বিষ্ণুপ্রিয়া
অভিনেত্রী হিসেবে সুচিত্রা সেনের উত্তরণের পালা 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' ছবি থেকে। দেবকী কুমার বসু পরিচালিত এ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন তিনি। সুচিত্রা সেন নিজে বলেছেন, 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' ছবিটি আমার জীবনকে পাল্টে দেয়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫-এ তিন বছর পর পর অনেক ছবি মুক্তি পেয়েছে মহানায়িকার। পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের 'ঢুলি', সুকুমার দাশগুপ্তের 'সদানন্দের মেলা', অগ্রদূতের 'অগি্নপরীক্ষা', সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের 'সাঁঝের প্রদীপ', সুধীর মুখোপাধ্যায়ের 'শাপমোচন', অগ্রদূতের 'সবার উপরে' ছবিগুলো বক্স অফিসে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে।
অমোঘ আকর্ষণ
উত্তম-সুচিত্রার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার ফলে সেই সময়ের বাঙালির সামাজিক জীবনেও কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। উত্তম-সুচিত্রার বিভিন্ন ছায়াছবি দৃশ্যের অনুকরণে নবদম্পতিরাও ফটো স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলে যথেষ্ট আনন্দ লাভ করতেন। এমনকি লক্ষ্মী ও সরস্বতী প্রতিমা সুচিত্রার মুখের আদলে গড়া হয়েছে। উত্তম-সুচিত্রা জুটি শুধু অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই লাভ করেনি; বাংলা ছায়াছবির জগতে স্টার সিস্টেমও প্রবর্তন করে।
সুচিত্রা তার মুডের জন্যও সব সময় আলোচনায় ছিলেন। একবার অজয় করের 'সাত পাকে বাঁধা'র শুটিং চলে কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডের ২ নাম্বার স্টুডিওতে। বারান্দায় ফোরগ্রাউন্ডে ছিল খাঁচাবন্দি একটি সবুজ রঙের টিয়ে। পাখিটাকে নিয়ে সুচিত্রার একটা শট ছিল। সেটা হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ ফ্লোর থেকে বেরিয়ে এসে খাঁচাটার দোর খুলে হাততালি দিয়ে পাখিটাকে উড়িয়ে দিলেন নীল আকাশে। টিয়ে পাখিটিকে নিয়ে কন্টিনিউটি শট ছিল। কিন্তু পাখিটিকে এভাবে উড়িয়ে দেয়ায় পরিচালক অজয় কর সুচিত্রার কাছে কৈফিয়ত তলব করলেন। সুচিত্রা একটু হেসে বললেন, 'বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল বেচারা! তাই উড়িয়ে দিলাম। সরি।'
পরিচালক অসিত সেনের 'দীপ জ্বেলে যাই' ছবিতে নার্স রাধা মিত্রের চরিত্রেও সুচিত্রার অভিনয় ইতিহাস হয়ে থাকবে। প্রথম তিনি দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন 'স্মৃতিটুকু থাক' ছবিতে। অসিত বাবুর ছবি 'উত্তর ফাল্গুনী'-তে মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় সুচিত্রার অভিনয়ের তুলনা মেলা ভার। পরে এ ছবিটিই হিন্দিতে 'মমতা' নামে রিমেক করা হয়েছিল। এতে সুচিত্রার বিপরীতে ছিলেন ধর্মেন্দ্র। জনপ্রিয় ছবি 'হসপিটালে' বম্বের প্রখ্যাত নায়ক অশোক কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন সুচিত্রা। সুশীল মজুমদার পরিচালিত এ ছবির নায়িকা শর্বরীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি।
উত্তম-সুচিত্রা বিবাদ
১৯৬১ সালে 'সপ্তপদী' মুক্তি পেলেও ছবিটির শুটিং হয়েছিল অনেক আগে। সুপরিকল্পিতভাবে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ লাগিয়ে দেয়ার ফলে ছবির কাজ বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। তাই 'সপ্তপদী' তৈরি হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। কী সেই বিবাদ? সুচিত্রা সেনকে বোঝানো হয়েছিল, উত্তম কুমারের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে থাকলে তার খ্যাতির প্রকাশ ঠিকভাবে ঘটবে না।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার
মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে 'সাত পাকে বাঁধা' ছবিটি প্রদর্শিত হয়। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান সুচিত্রা। এর আগে নার্গিসই ছিলেন একমাত্র ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি 'মাদার ইন্ডিয়া'র জন্য কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন।
গ্ল্যামার ও অভিনয়
গ্ল্যামার ও অভিনয়ের দাপট- সব মিলিয়ে সুচিত্রা সেন তার উপস্থিতির জোরে 'ফরিয়াদ'-এর মতো শক্ত বিষয়ের ছবিকেও সুপারহিট করিয়ে দিয়েছিলেন। একই কথা বলা চলে দীনেন গুপ্তের 'দেবী চৌধুরানী' ছবির ক্ষেত্রেও। অজয় করের 'দত্তা'ও সুপারহিট হয়েছিল সুচিত্রার অভিনয়ের জোরেই।
ঘর সাজানো
অভিনয়ের বাইরে সুচিত্রার ঘর সাজানোর অভ্যাস বহুদিনের। নিজের হাতে তার শোবার ঘর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতেন। পছন্দ করতেন গাছপালা ও পশুপাখি। বিভিন্ন ধরনের উপাদানসামগ্রীতে সাজানো থাকত তার বাড়ির ড্রইংরুম। শেষ দিনগুলোয় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছেন শুনলে, গোপন ক্যামেরায় টিভি স্ক্রিনে সেই সাক্ষাৎপ্রার্থীকে দেখে তবেই ফ্ল্যাটে ঢোকার অনুমতি দিতেন।

একসময় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে তার বিশাল দোতলা বাড়িতে কে না গিয়েছেন! হিন্দি ছবির বড় বড় নায়কও সেখানে গিয়ে পড়ে থাকতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অশোক কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র প্রমুখ। রাজ কাপুর ও সুচিত্রা সেনকে নিয়ে মজার একটা গল্প রয়েছে। একবার রাজ কাপুর সুচিত্রাকে তার কোনো ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছিলেন। তার পরনে সাদা ধবধবে প্যান্ট-কোট ও হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ ছিল। এ গোলাপ দিয়েই সুচিত্রাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তিনি।
গোপালপুরের নির্জনতা
গোপালপুরের সমুদ্রসৈকত বড়ই প্রিয় ছিল সুচিত্রা সেনের। এখানকার নির্জনতা দারুণ উপভোগ করতেন তিনি। তাই তার কোনো ছবির সিকোয়েন্স সমুদ্রের ধারে থাকলে শুটিংয়ের জন্য গোপালপুরকেই বেছে নিতেন।
সুচিত্রা-সন্ধ্যা
'অগি্নপরীক্ষা' থেকে শুরু করে একের পর এক ছবিতে সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। বাস্তবিকভাবেই তারা যেন একে-অন্যের জন্যই জন্মেছেন। মহানায়িকার লিপে মহাগায়িকা সন্ধ্যার সব থেকে বেশি গানের দৃশ্যধারণ হয়েছে। সুচিত্রার লিপ দেয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।
অনন্য 'অাঁধি'
'অাঁধি' ছবির শুটিংকে কেন্দ্র করেই হিন্দি ছবির প্রতিষ্ঠিত পরিচালক, গীতিকার গুলজারের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল মহানায়িকার। 'দেবদাস', 'মুসাফির', 'চম্পাকলি', 'বোম্বাই কা বাবু', 'শরহদ', 'মমতা' প্রভৃতি ছবির থেকেও 'অাঁধি'র সুচিত্রা ভারতীয় দর্শকমহলে এক অনন্য আবেদনের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ছবিটি ১৯৭৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল।
সুচিত্রার অপ্রাপ্তি
কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করা হয়ে ওঠেনি সুচিত্রা সেনের। সুচিত্রা সেনের অভিনয় জীবনের সব থেকে বড় অপ্রাপ্তি সম্ভবত এটিই। সত্যজিৎ রায় সুচিত্রাকে নিয়ে 'দেবী চৌধুরানী' করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুচিত্রা শিডিউল দিতে না পারায় সত্যজিৎ বাবু ছবিটি করেননি। অবশ্য পরে সুচিত্রাকে নিয়ে দীনেন গুপ্ত ছবিটি করেছিলেন।
গায়িকা সুচিত্রা
মেগাফোন কোম্পানির ব্যানারে সুচিত্রা দুটো পুজোর গান রেকর্ড করেছিলেন। এর সুর করেছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। গানের কথা লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
প্রিয় খাবার
সুচিত্রা সেন বরাবরই আর্লি রাইজার ছিলেন। ভোরে উঠতেন। কখনোসখনো ইচ্ছা হলে বাড়ির সামনে রাস্তায় হাঁটতেও বের হতেন। ইচ্ছা হলে রান্নাঘরেও ঢুকে পরতেন তিনি। নিজেই রান্নাবান্না করতেন। পাঁঠার মাংস থেকে মুরগির মাংসই ছিল তার বেশি পছন্দের। সুচিত্রা সেনের প্রিয় মাছ ছিল মাগুর, বড় রুই মাছের পেটি, কই, চিংড়ি ও ভেটকি। রসুন ভেটকি তার একটি পছন্দের খাবার। তিনি থাই খাবারও ভালোবাসতেন।
ঠাকুরঘরে সুচিত্রা
সুচিত্রা সেনের আধ্যাত্মিক জীবনের কথা তার অভিনয় জীবনের থেকে কম আকর্ষণীয় নয়। অভিনয় থেকে সরে আসার পর তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। তার শোবার ঘরের পাশেই ঠাকুরঘর স্থাপন করা হয়েছিল। কী শীত, কী গ্রীষ্ম; সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে স্নান সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়তেন তিনি। সাড়ে ১১টার আগে সেখান থেকে বের হতেন না। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত ছিলেন তিনি। প্রায়ই বেলুড় মঠে ভরত মহারাজ, স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর কাছে ছুটে যেতেন তিনি। সুচিত্রা রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, 'মাঝেমধ্যে বড় কষ্ট হয়। যন্ত্রণা হয় ভেতরে। তখন কিছু ভালো লাগে না। তাই যন্ত্রণা লাঘবের জন্য ছুটে যাই গঙ্গার ওপারে-বেলুড়ে। শ্রীশ্রীঠাকুরের পায়ের কাছে বসে থাকি।'
অন্তরালে মহানায়িকা
রহস্যজনক এক কারণে হঠাৎ করেই অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। তাকে সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে জনসম্মুখে দেখা গিয়েছিল। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জন-অন্তরালেই থেকেছেন।

অসুস্থ হয়ে সুচিত্রা সেন টানা ২৫ দিন কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তার সুচিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তাকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতেই হলো।

January 18, 2014

পাতানো নির্বাচন এবং এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রশ্ন

১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ তার সব কর্মকাণ্ডে জনগণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করেছে। অথচ সেই দলটি নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচন হাইজ্যাক করেছে এবং শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের ভোটের অধিকারকে অস্বীকার করেছে। এ নির্বাচনে তথাকথিত বিজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে- ৩০০টির মধ্যে ১৫৩ আসনে প্রার্থী জয়ী হওয়ার জন্য একটি ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি। এটা যদি পূর্বনির্ধারিত না হয় তাহলে কি? এসব এ নির্বাচনকে পাতানো এবং ফলাফলকে বল প্রয়োগের বিজয়ের খেতাব এনে দিয়েছে। এরপর নতুন সরকার গঠনের বিষয়টি আসে, যা যে কোন নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যে। এ সরকারও গঠন হয়েছে ভোটারদের কোন ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়া। আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা যদি আমরা বিশ্বাস করি তবে গণতন্ত্র হচ্ছে, জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। তাহলে ৫ই জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের সরকার নয়, জনগণের দ্বারা গঠিতও নয়। এ সরকার  জনগণের জন্য কিনা তাও কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারবে। শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেননি। যদিও তিনি সব সময় দাবি করে থাকেন গণতন্ত্রের জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিতকতার নামে তিনি এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী যে নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট পড়েছে ৩৯ শতাংশ। যা গত নির্বাচনে ৩০০ আসনে পড়া ৮৭ শতাংশ ভোটের তুলনায় অনেক কম। এবারের নির্বাচনে ভোট পড়ার যে হারের কথা বলা হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটের দিন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় যে চিত্র দেখা গেছে তাতে ভোটের হার কিছুতেই ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি হতে পারে না।
৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাওয়া। গত দুই যুগ ধরে তাদের যে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, প্রতি ৫ বছর পর পর তারা কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের মত প্রকাশ করতে পারবেন। এখন এ বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। এটাও প্রমাণ হয়েছে, আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অধীনে কোন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি-ই হোক। এখন আমরা একটি মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন কি এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি। সমালোচক হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রের বন্ধু হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে তার হাতে থাকা অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে সতর্ক করছি। লর্ড অ্যাকটিন এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়। আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- নির্বাহী বিভাগ, সংসদ এবং বিচার বিভাগ। আজকের দিনে শেখ হাসিনা প্রশ্নাতীতভাবে এবং কার্যকরভাবে দু’টি স্তম্ভ নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণভাবে রীতি অনুযায়ীই আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইন প্রণয়নকারী বিভাগ-সংসদের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিরাট প্রভাব রয়েছে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনের পর নতুন অগ্রগতিও হয়েছে। এমনকি এখন বিরোধী দলও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিরোধী দলের একটি অংশ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে, আরেকটি অংশ রয়েছে বিরোধী দলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। আমরা সবাই জানি, কিভাবে বিরোধীদলীয় নেতা তৈরি করা হয়েছে। এবং তথাকথিত বিরোধীদল কিভাবে সরকারের মন্ত্রিসভায় আরও স্থান পাওয়ার জন্য দরকষাকষি করছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদের ওপরও প্রধানমন্ত্রীর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি থাকে বিচার বিভাগ। ঐতিহ্যগতভাবেই বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে থাকে। উচ্চ আদালতের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না। আমরা এখন এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছি যেখানে সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভারসাম্য নেই। সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাসের ওপরই সুশাসন নির্ভর করে। রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে গেলে তা সরকার ব্যবস্থার জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। সরকার ব্যবস্থায় ভারসাম্য নীতির অভাব আরও অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে। সাধারণ পরিস্থিতিতে কোন দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়কর হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপের ইতিহাস রয়েছে। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিয়ন্ত্রণাধীন বিরোধী দল, ভারসাম্যহীন ক্ষমতার অধিকারী নেতার আবির্ভাব এবং এমন কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা যা তাকে দায়বদ্ধ করতে পারে, এ অবস্থায় লর্ড অ্যাকটিনের ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। এটা রেকর্ডে থাক যে, সর্বপ্রথম সতর্কঘণ্টা আমরাই বাজিয়েছিলাম।
 
(১৭ই জানুয়ারি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)
Khoj Khobor