হাসান শাফিঈ, কাজী সোহাগ: বিদেশী কেউ নয়- এবার ইন্টারনেটে সেক্স অফার করেছে বাংলাদেশেরই এক মেয়ে। নিজের বয়স ২০ উল্লেখ করে ফেসবুক সাইটের মতো সার্চেবল ওয়েবসাইট ট্যাগ্ড্-এ লোপা নামের ওই মেয়ে লিখেছে, ইফ এনি-ওয়ান ওয়ান্ট টু সেক্স, দ্যান ইউ ক্যান কল টু মি, পার আওয়ার ফাইভ থাউজেন্ড টাকা অনলি, ডোন্ট মিট টু আউট পেস্নস- ওকে, কল মি (এরপর একটি জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটরের ফোন নম্বর)-কেউ সেক্স চাইলে আমাকে ফোন করতে পারো, প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকা। বাইরে দেখা করি না। পাশে আকর্ষণীয় একটি টু কোয়ার্টার ছবি। ছবি আপলোড করার সুবিধা থাকা সাইটগুলোতে আজকাল হরহামেশা একজন অন্যজনের ছবি ও ফোন নম্বর প্রকাশ করে বিশেষত মেয়েদের বিব্রত করছে। এ কারণে ওই অফারের সত্যাসত্য যাচাইয়ে অনুসন্ধানে নামা হয়।
এরই অংশ হিসেবে দুসপ্তাহ আগে নিজেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী পরিচয় দিয়ে ফোন করা হয় নম্বরটিতে। ফোন রিসিভ করে একটি মেয়ে। জানতে চায়- নম্বরটি কোথায় পেয়েছেন? ওয়েবসাইটে! মেয়েটির জিজ্ঞাসা, কি নাম লেখা হয়েছে ওখানে? লোপা। মেয়েটি আবারও জিজ্ঞাসা করে আর কি লেখা আছে? ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকা। মেয়েটি বলে, ঠিক আছে। কবে কখন আসতে চান। জবাবে বলা হয়, তার আগে বলুন- কোথায় আসতে হবে। মেয়েটির জবাব- মিরপুর-১১ ইস্টার্ন হাউজিং-এ। আমার বাসায়। তবে আসার অনত্মত দু ঘণ্টা আগে ফোন দিতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস থাকে তো ভাইয়া! কোথায় পড়ছেন? মেয়েটি একটি শীর্ষ স্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উলেস্নখ করেই বলে, এত কথার প্রয়োজন নেই। কবে আসতে চান বলুন? জবাবে বলা হয়, এখন তো মাসের মাঝামাঝি। টাকার পরিমাণও বেশি। সামনে মাসে বেতন পেয়ে আসি? ওকে, ঠিক আছে। আসার আগে ফোন দিয়েন। রাখি। এরপর ট্যাগ্ড্ সাইটে গিয়ে মেয়েটির নাম ও বয়স উলেস্নখ করে সার্চ দিলে ওয়েবপেজটিতে লোপার ছবি ও ভিউ প্রোফাইল আসে। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, লোপা নামে যে ছবিটি দেখানো হচ্ছে সেটি আসলে দড়্গিণ ভারতের ছবির নায়িকা চার্মির। আর সাইটটিতে লোপার একাউন্ট খোলা হয়েছে গত ৭ই ডিসেম্বর। এরপর সোমবার সকাল পৌনে ১১টায় আবারও ফোন করা হয় নম্বরটিতে। মেয়েটি আগের মতোই প্রশ্ন করে নিশ্চিত হয়ে নেয় সব। সঙ্গে রেটের বিষয়টিও। তারপর মিরপুর ১১-এর এভিনিউ ৫ মদিনা নগরে চলে আসবেন। নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিনত্মা করার কিছু নেই। এসে ফোন দেবেন। বাসার নম্বর জানিয়ে দেবো। সোজা দোতলায় উঠবেন। বাম দরজায় নক করবেন- নয়তো মিসকল দিবেন। আপনার মোবাইল নম্বর সেভ করে রাখছি। কোন অসুবিধা নেই। প্রশ্ন করা হয়, বাসায় কে কে থাকবে। মেয়েটি জানায়, আমার এক বান্ধবী। সে-ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সাব্যসত্ম হয় মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে সোয়া ১১টার মধ্যে মদিনা নগরে পৌঁছতে হবে। সমস্যা দেখা দেয় নিরাপত্তা নিয়ে। কলিগরা জানান, অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ। এদের পেছনে একটি শক্তিশালী গ্রম্নপ থাকে। হয়তো অপহরণকারী নেটওয়ার্কও এর পেছনে আছে। ঘণ্টায় পাঁচ হাজার টাকা বিজ্ঞাপন দেয়া মানে যারা এতে সাড়া দেবে তারা সচ্ছল। ট্র্যাপ করলেই কাঁচা অর্থ। এ ধরনের নানা বিপদ মোকাবেলার জন্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নেয়ার পরামর্শ আসে সবার কাছ থেকে। পাশাপাশি নিরাপত্তার স্বার্থে একজনের পরিবর্তে অনত্মত দু’জন যাওয়ার পরামর্শ আসে। একজন বাইরে। অন্যজন ভেতরে। ভেতরে বিপদের আঁচ পেলেই ফোন করতে হবে। অন্যদিকে, বাইরের জন্য কিছুড়্গণ পর পর ফোন করে পরিস্থিতি বুঝে নেবে। এই দ্বিতীয়জন হিসেবে অভিযানে নামতে রাজি হয় আরও একজন সংবাদকর্মী।
মদিনা নগরে পৌঁছার আগেই দু’জনকে আলাদা হতে হয়। প্রথমজনকে ফলো করার দায়িত্ব পড়ে দ্বিতীয় জনের ওপর। নির্ধারিত সময়ে মদিনা নগর পৌঁছে ফোন দেয়া হয় লোপাকে। সাজ কানন বিউটি পার্লারের সামনে দু’মিনিট অপেড়্গা করতে বলা হয়। মিনিট দশেক পর আবার ফোন দেয়া হয়। এবার বলা হয়, রিকশা করে এত নম্বর রোডের এত নম্বর বাসায় চলে আসুন। আলাদা দু’টি রিকশায় নির্ধারিত রোডটিতে পৌঁছে যায়। ফোনের ডিরেকশনে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির দোতলায় পৌঁছতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে ঢুকতেই নিজেকে লোপা পরিচয় দিয়ে মেয়েটি দু’রম্নমের বাসার একটি রম্নমে বসতে বলে। ছোট ড্রয়িং রম্নমটি একেবারে ফাঁকা। আসবাবপত্র শূন্য। অন্য দু’রম্নমে সামান্য আসবাবপত্র। একটি ২১ ইঞ্চি কালার টিভি। দু’রম্নমে দু’টি সাধারণ খাট। একটি পড়ার টেবিল। কিছু একাডেমিক বইপত্র। কয়েকটি অনুশীলন খাতা। খাতার ওপর লেখা তাসলিমা। বলেন, নেটে লোপা লিখেছি। ছবিটাও আমার নয়। ভারতীয় এক মডেলের ছবি। জানতে চাওয়া হয়, ঘণ্টার হিসাব কিভাবে করেন? লোপা বলেন, এই যে গল্প করছেন এটা ঘণ্টার হিসাবের বাইরে। অনত্মরঙ্গ হওয়ার সময় থেকে ঘণ্টার হিসাব। এ এক ঘণ্টায় যতবার পারেন ততবার সেক্স করতে পারবেন। নেটে আহ্বান জানানোর চিনত্মাটা কিভাবে মাথায় এলো? লোপা জানান, আগেই বলেছি, বেসরকারি বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। এখন বিবিএ’র থার্ড সেমিস্টার চলছে। আরও ৯ সেমিস্টার বাকি। পুরো কোর্সে আমার খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ টাকা। মানিকগঞ্জের একটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীড়্গা দিয়েই প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে আসি। বাবা আর্মি অফিসার। তিনি এটা মেনে নেননি। কয়েক মাস পর হাজব্যান্ড উধাও হয়ে যায়। অথৈ পানিতে পড়ে যাই আমি। বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল হলেও ঘরে ফিরে যাইনি। সিদ্ধানত্ম নিই পড়াশোনা চালাতে হবে। আর্থিক অনটনে পড়ে এক ছেলেবেলার বন্ধুর কাছে ৩০ হাজার টাকা চাই। সে আমাকে বলে, টাকা দিতে রাজি আছি। তুমি কি দেবে বলো? জানোই তো পৃথিবী হচ্ছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর জায়গা। কিছুটা আঁচ করতে পেরেও নিশ্চিত হতে তাকে জিজ্ঞাসা করি- তুমি কি চাও বলো। সে ওই টাকার বিনিময়ে আমার সঙ্গে এক রাত কাটাতে চায়। নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া শেষে তার প্রসত্মাবে রাজি হয়ে যাই। আমার মনে তখন পড়াশোনা আরম্ভ করার আনন্দ! রাত কেটে যায়। হাজব্যান্ড উধাও হওয়ার পর ওই প্রথম রাতটা আমার ভাল কাটে। বন্ধু আমাকে সারারাত মাতিয়ে রাখে। তখন মিরপুর-১১-তেই এক বাসায় সাবলেট থাকতাম। পরদিন সারাবেলাই আমার ভাবতে ভাবতে কেটে যায়। মনে মনে ভাবি, আমিও কি আর দশটা মেয়ের মতো প্রফেশনাল হয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়ালাম! এ পথে তো আমার নিয়মিত হাঁটাচলা করা সম্ভব নয়। পড়াশোনা চালাতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া আমি তো এক সময় বাবার সামনেও দাঁড়াতে চাই। বলতে চাই, বাবা আমি এখন প্রতিষ্ঠিত। পড়াশোনা শেষ করে কোচিং সেন্টার চালাচ্ছি। মাস গেলে লাখ টাকা আয় করছি। আমি ভাল আছি। সাধারণ মেয়ের মতো এ-হোটেল ও-হোটেলে গেলে স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়। আগে থেকেই সাইবার ক্যাফেতে যাওয়া-আসা ছিল। চেনা-জানা আনেকেরই ফেসবুকে একাউন্ট থাকায় সিদ্ধানত্ম নিই অফ ট্র্যাকের কোন সাইটে একাউন্ট খুলবো। তারপর এক বন্ধুর সহায়তায় ওই একাউন্ট খুলি। ডিজিটাল সেক্স অফার বলে রেটটা বেশি রাখি। এতে সুবিধা অনেক। আমাকে কোথাও যেতে হয় না। একদিনে অনেক পুরম্নষকে সঙ্গ দিতে হয় না। এক ঘণ্টায় সাধারণভাবে এক পুরম্নষ দু’বারের বেশি মিলিত হতে পারে না। ফলে আমি সেক্সটা এনজয় করতে পারি। অনেক গল্প শোনালাম। আর না। এখন টাকা দিন। লোপার হাতে এক হাজার টাকার পাঁচটি নোট তুলে দেয়া হয়। সে অনত্মরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে। তাকে বলা হয়, ও সবের দরকার নেই। নেটের ছবির সঙ্গে আপনার মিল নেই।
লোপার সঙ্গের সেই মেয়েটি...
ইন্টারনেটে সেক্স অফার করা ঢাকাই তরম্নণী লোপার বাসায় আরও এক মেয়ের উপস্থিতি ছিল। লোপার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ হলেও অন্যজনের রঙ দুধে-আলতা। সাদা চোখে মেয়েটির বয়স ১২ বা ১৩ বছরের বেশি মনে হয় না। যদিও লোপার ভাষ্য-দু’জনের বয়সের পার্থক্য তেমন নেই। বাসায় কে কে থাকে-এ প্রশ্নে সোমবার লোপা জানিয়েছিল, বাসায় এক বান্ধবী আছে। সে-ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে মুখোমুখি বসা কথপোকথনে লোপা জানায়, ওর নাম সামিয়া আক্তার জুঁই। ইন্টারমিডিয়েট পড়তো। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন সে। বাসা আমিনবাজারে। বাবার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তারপরও কষ্টে-সৃষ্টে চলে যেতো তাদের সংসার। হঠাৎই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে ওদের। ওর বড় ভাই গাড়ি চাপা পড়ে। ধার-দেনা করা অর্থে চিকিৎসায় প্রাণ রড়্গা হলেও অ্যাবনরমাল হয়ে যায়। অর্থ সঙ্কটে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ওর। সংসারের ঘানি এসে পড়ে ওর ঘাড়ে। দরজা খোলা থাকায় চোখ চলে যায় মেয়েটির দিকে। মুগ্ধ করার মতো সুন্দরী সে। তার সামনে মোটা চালের এক থালা ভাত। আলুর কারির সঙ্গে এক খণ্ড মাছ। লোপাকে বলা হয়, আপনার আয়ের সঙ্গে এই মোটা চাল যায় না। সে জানায়, আয়টাই দেখছেন? প্রতি মাসেই বাসা পাল্টাতে হয়। ভাড়াটাও বেশি গুণতে হয়। ব্যাচেলার বাসা পাওয়া যায় না। একজন হাজব্যান্ড সাজাতে হয়। সঙ্গ দেয়ার পাশাপাশি মাসে মাসে তাকেও দিতে হয় বড় অঙ্কের টাকা। এরপরও আমাদের দু’জনের ভাগ্যটা ভাল। আমার জনি আর জুঁই’র দীপ্ত-দু’জনই ভাল। নির্দয় আচরণ করে না ওরা। জনি আমাকে কোচিং সেন্টার খোলার পথে সাহায্য করছে। জুঁইকেও তেমন কারও সঙ্গে মিশতে হয় না। দীপ্তই ওকে নিয়মিত টাকা-পয়সা দেয়। মাসের শুরম্নতে জুঁই ওই টাকা বাবা-মাকে দিয়ে আসে। ওর বাবা-মা জানে-ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি করে। লোপা জানায়, ইন্টারনেটে ওর-ও একটা একাউন্ট আছে। ওর ব্যক্তিগত পরিচয়ের সীমানাটা ছোট। এজন্য ও ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে। আমার বন্ধুই ওকে ওটা খুলে দিয়েছে। লোপার গল্প শোনা শেষে তার হাতে যখন পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেয়া হয় তখন সে অনত্মরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে। লোপাকে বলা হয়, ওসবের দরকার নেই। নেটের ছবির সঙ্গে আপনার মিল নেই। এ পর্যায়ে লোপা নতুন গল্প শোনায়। বলে, জুঁইকে সঙ্গে রাখা শুরম্ন করার পর থেকে এ সমস্যাটা দেখা দিয়েছে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে যারাই বাসায় আসে-তারাই বেঁকে বসে। চোখ চলে যায় ওর দিকে। এজন্যই ফোনে বলে দিই-বাসায় এলে টাকা দিতেই হবে। সেক্স ব্যাপার নয়। আমাকে চিনে ফেলার দামই পাঁচ হাজার। আর জুঁইয়ের দিকে নজর দিয়ে লাভ নেই। ওর গেস্ট ওর। হাজার চাইলেও আমি ওর গেস্টকে সঙ্গ দিই না। অন্যদিকে, লাখ টাকা দিয়ে চাইলেও আমার গেস্টকে ও এন্টারটেইন করে না। চাইলে ওর মোবাইল নম্বরটা নেয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। লোপার কথা কানে যায়, মন পড়ে থাকে জুঁইয়ের জন্য কিছু করার। মনে পড়ে, ক’বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র খদ্দের হয়ে এক বাসায় গিয়ে বিপদগ্রসত্ম এক মেয়েকে আইন-সালিশ কেন্দ্রের সহায়তা নিয়ে উদ্ধার করেছিল। জুঁইয়ের জন্য কি তেমন কিছু করা যায় না!
No comments:
Post a Comment