July 2, 2013

অভিনেত্রী মিতা নূরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার - নেপথ্যে স্বামীর পরকীয়া!

রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে অভিনেত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিতা নূরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার সকালে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। তবে তিনি আত্মহত্যা করেছেন না কি এটা হত্যাকাণ্ড তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি পুলিশ। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম সমকালকে জানান, সোমবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে মিতা নূরের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ফোন পেয়ে পুলিশ তার গুলশান-১ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে ড্রয়িং রুমের ফ্যানের সঙ্গে মিতা নূরের লাশ ঝুলতে দেখেন তারা।

পারিবারিক কলহের জের ধরে সদা হাস্যোজ্জ্বল জনপ্রিয় টিভি নায়িকা ও মডেল মিতা নূরের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি কি আত্মহত্যা করেছেন, না তাকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে— এ প্রশ্ন অনেকেরই। কোনও-কোনও সূত্র বলছে, ব্যবসায়ী স্বামীর পরকীয়া নিয়ে মিতা নূর দম্পতির মধ্যে পারিবারিক কলহ জট পাকায়। এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবেই জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীকে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয়। ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ মিতা নূরের স্বামী বায়িং হাউস ব্যবসায়ী শাহনূর রহমান রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এদিকে গতরাতে মিতা নূরের বাবা ফজলুর রহমান তার মেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন।

গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল ভোরে মিতা নূরের স্বামী শাহনূর রহমান রানা থানায় ফোন করে জানান— মিতা নূর আত্মহত্যা করেছেন। খবর পেয়ে সকাল ৭টার দিকে পুলিশ গুলশান-২ লেকভিউর ১০৪ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টের ৬ তলায় অবস্থিত মিতা নূরের বাসায় যায়। সেখানে ড্রয়িংরুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো তার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। পরে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে ফ্যান থেকে মিতা নূরের মৃতদেহ নামায় পুলিশ। ঘটনার খবর পেয়ে সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থল আসেন এবং মৃতদেহের ছবি তোলেন। জব্দ করেন বেশকিছু আলামত।

জানা গেছে, কিছুদিন ধরেই মিতা নূর চরম পারিবারিক কলহের মধ্যে ছিলেন। মাঝে মধ্যেই স্বামী শাহনূর রানার সঙ্গে বাগিবতণ্ডা হত। কিন্তু কী নিয়ে তাদের মধ্যে এই কলহ এ বিষয়ে পুলিশ ও পরিবারের কেউ মুখ খুলছেন না। একটি সূত্র অবশ্য বলেছে, মিতা নূর তার স্বামীকে সন্দেহ করতেন। এ নিয়ে কলহের শুরু। তাদের মধ্যকার পারিবারিক কলহের বিষয়টি ঢাকার পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত গড়িয়েছিল। পুলিশ কমিশনার গুলশান থানার ওসিকে তাদের মধ্যকার বিবাদ মেটানোর দায়িত্ব দেন। গত রোববার মহানগর পুলিশের অপরাধ সভা থেকেও কমিশনার এ বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান ওসির কাছে। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও পুলিশ দু’জনার দূরত্ব কমাতে পারেনি। সূত্র এও বলেছে, মিতা নূরের এক বোনের সঙ্গে তার স্বামী শাহনূরের পরকীয়া ছিল। এ পরকীয়া এতটাই গভীর হয়েছিল যে, তাকে ছাড়া কিছু বুঝত না তার স্বামী। ওই বোনের সঙ্গে ঘন-ঘন টেলিফোনে কথাবার্তার সূত্র ধরেই মিতা নূরের কাছে স্বামীর পরকীয়া ধরা পড়ে। মিতা নূর স্বামীকে এ পথ থেকে ফেরাতে বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ নিয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে এর আগে দু’বার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

এদিকে মিতা নূরের লাশ ময়নাতদন্তের পর গতকাল বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মিতা নূর আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর যত কারণ থাকে তার সবই মিতা নূরের দেহে পাওয়া গেছে। এছাড়া শরীরের বাইরে বা ভেতরে কোনও ধরনের জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, তবে এ মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে কিডনি, লিভার ও পাকস্থলীর অংশবিশেষ রাসায়নিক পরীক্ষার (ভিসেরা) জন্য রাখা হয়েছে।

মিতা নূরের বাবা ফজলুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে মাঝে মধ্যেই তাদের মধ্যে বাগিবতণ্ডা হত। মেয়েজামাই মিতার ওপর অত্যাচার করত। তাদের দুটি বড় ছেলে থাকায় আমরা এ নিয়ে ভাবতাম না। তবে সকালে টিভি স্ক্রল দেখে মেয়ের মৃত্যুর খবর পাই।

গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূরে আজম জানান, গত শনিবার মিতা নূর নিকেতন ৩ নম্বর সড়কে স্বামী রানার বায়িং হাউসে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে বলে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে মিতা নূর ও তার স্বামী পুলিশকে জানান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। পুলিশের আর দরকার নেই। তখন পুলিশ চলে আসে। নূরে আজম আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে মিতা মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এ কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মিতা নূরের সংসারে ২ ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে সেজানুর তাউস প্রিয় (১৬) উত্তরার আগা খান ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে এবার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে আর ছোট ছেলে সাদমান রহমান পৃথ্বী (১২) গুলশানের সি-ব্রিজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে।

এদিকে স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত দাবি করে মিতা নূরের স্বামী শাহনূর রহমান রানা বলেন, শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, ভালো বন্ধু হিসেবে আমরা একে অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিলাম। মিতা কখনও তার সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে শেয়ার করেনি। সে কিছুদিন ধরে শুটিংয়ে না গিয়ে বিষণ্নচিত্তে প্রায় সময়ই ঘুমিয়ে থাকত। কখনও-কখনও ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাত। এ বিষয়ে মিতার কাছে জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলত না। রানা আরও বলেন, গত ২৩ জুন বিবাহবার্ষিকীতে মিতা ও ২ ছেলেকে নিয়ে একসঙ্গে বাইরে হোটেল লাঞ্চ ও  ডিনার করি।

গত রোববারের ঘটনা প্রসঙ্গে রানা জানান, সকালে সবাই একসঙ্গে নাস্তা করি। পরে আমি অফিসে যাই। বিকালে ফিরে দেখি মিতা শুয়ে আছে। জানতে পারি ও পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সে সময় জোর করেই ওকে ব্যথার ওষুধ খেতে দিই। এরপর রাত ১০টায় বাসায় ফেরার সময় সিঁড়ির পাশে কতগুলো ঘুমের ওষুধের পাতা পড়ে থাতে দেখি। এ নিয়ে মিতাকে কিছুই বলিনি। তখনও মিতা শুয়েছিল। এরপর বড় ছেলে প্রিয়কে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ড্রয়িংরুমে গল্প করে ঘুমাতে এসে দেখি মিতা মোবাইলে গান শুনছে। তখন গান বন্ধ করে দু’জন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। রানা আরও বলেন, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ছোট ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে গিয়ে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে দেখি সে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। তখন পুলিশে খবর দিই।  মিতা নূরের গাড়িচালক সবুজ বলেন, সকাল ৭টার দিকে সাহেবের ছোট ছেলে পৃথ্বীকে স্কুলে নিতে বাসায় এলে স্যার বলেন, তোমার ম্যাডাম তোমার সঙ্গে তো খারাপ ব্যবহার করত। এখন থেকে আর করবে না। এরপর স্যারের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে গিয়ে ম্যাডামের ঝুলন্ত লাশ দেখি। তিনি আরও বলেন, কী কারণে ম্যাডাম মারা গেছে জানি না। তবে মাঝেমধ্যেই ম্যাডাম টেলিফোনে রাগারাগি করত।  

বাসার গৃহপরিচারিকা হালিমা বলেন, প্রায়ই স্যার ও ম্যাডামের মধ্যে তর্কবিতর্ক হত। তবে ঝগড়া বা মারধরের বিষয়টি তিনি দেখেননি।

এদিকে মিতা নূরের মৃত্যুর খবরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। মিতা নূরের বাসায় ছুটে যান অভিনেতা তারিক আনাম, অভিনেত্রী তারানা হালিম এমপি, দীপা খন্দকার, রোকেয়া প্রাচীসহ নাট্যঙ্গনের অনেকেই।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor