May 11, 2013

মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমা

রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধার হয়ে মৃত্যুকে জয় করলেন গার্মেন্টকর্মী রেশমা। মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমাকে এক ঘণ্টা চার মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে জীবিত ও অনেকটা সুস্থ অবস্থায় বের করে আনে উদ্ধারকারী দল। রেশমা রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের অপারেটর ছিলেন। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জের তুশগাড়ি গ্রামে। রেশমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম দিকে তিনি তৃতীয় তলায় ছিলেন। পরে ফাঁক দিয়ে নিচে নেমে আসেন। ওই সময় তাঁর আশপাশে কোনো জীবিত মানুষ ছিল না। দুর্ঘটনার পর কত দিন গেছে তা-ও বলতে পারছেন না রেশমা। রেশমা যেখানে ছিলেন সেখানে তিনি হাঁটতে পেরেছেন, বসতে পেরেছেন। এক বোতল পানি শেষ করেছেন কয়েক দিন ধরে। এরপর দেয়াল টপকে পড়া পানি পান করেছেন। পানিতে গন্ধ থাকার কারণে এক পর্যায়ে ওই পানি পান বন্ধ করে দেন রেশমা। তিনি আরো বলেন, পাশে অনেক লাশ ছিল। কিন্তু তিনি লাশের কাছ থেকে দূরে সরে ছিলেন। লাশের গন্ধ সহ্য করতে পারছিলেন না।
রেশমাকে উদ্ধারের অভিযানে থাকা সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, রেশমা দ্বিতীয় তলার একটি খোলা কক্ষে আটকে থেকে ভাগ্যগুণে বেঁচে ছিলেন। সেই স্থানেও ছিল আলো ও বাতাসের স্বল্পতা।
কিভাবে এত দিন বেঁচে ছিলেন? রেশমা বলেন, 'পানি খাইয়া ছিলাম স্যার। একটা বড় বোতল পাইছিলাম। ওইটা একটু একটু কইরা খাইছি, য্যান শেষ না হইয়া যায়। ওই পানিও এক সময় শেষ হইয়া গ্যাছে। দেওয়ালের পানি খাইছি। পরে আর গন্ধে খাইতে পারি নাই।' সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) প্রচণ্ড কড়াকড়ি ও গণমাধ্যমের জটলার ভিড়ে ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকারে রেশমা তাঁর ৪০৮ ঘণ্টা বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা এভাবেই জানালেন। 'আমি ভাবি নাই বাঁচমু। বাঁচার জন্য পাগলের মতো করছি। কোনো মানুষের সাড়া পাই নাই। কাঁদতেও পারি নাই। আমার আল্লাহ আমারে বাঁচাইছে।' হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন রেশমা। আরো বলেন, 'টিভির ক্যামেরা, কত মানুষ। আর কতক্ষণ আগেও ভাবছি, পৃথিবীর আলো দেখতে পামু না। উদ্ধারকারী ভাইদের দোয়া করি, তাঁরা যদি আমারে না দেখতেন তাইলে আমি শেষ হইয়া যাইতাম।' তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, আর বাঁচবেন না। তাই মানসিক বিপর্যয় আর কষ্টে নিজের মাথার চুল নিজেই কেটেছেন তিনি। চুল কেটেছেন কেন জানতে চাইলে রেশমা বলেন, 'আমি তো মনে করছিলাম বাঁচবই না, চুল দিয়া কী হবে। চুলের জন্য নড়তে পারছিলাম না। তাই কাপড় কাটার কাঁচি দিয়া চুল কাটছি।' ১৭ দিন পর উদ্ধার হয়েছেন শুনে নিজেও বিস্মিত রেশমা। বলেন, '১৭ দিন হইছে বুঝি নাই। তবে মনে করছি অনেক দিন হইয়া গ্যাছে। কেউ আমারে আর খুঁজব না। আমি মইরা যাচ্ছি।' কিভাবে ছিলেন- জানতে চাইলে রেশমা জানান, তিনি তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। ভবনধসের পর একটি অংশ দেবে নিচে পড়ে যান তিনি। এর কয়েক দিন পর অন্ধকারে খোঁজাখুঁজি করে একটি ফাঁক পান তিনি। ওই পথ দিয়ে নিচে নামেন। পরে তিনি একটি খোলা ঘর দেখেন। সেখানে কেউ ছিল না। আশপাশ থেকে শুধুই লাশের গন্ধ আসছিল। জায়গাটি এমন অন্ধকার ছিল যে দিন নাকি রাত বোঝা যাচ্ছিল না। বাতাস না থাকায় বারবার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ছোট একটি ফাঁক দিয়ে বাতাস আসত বলে ধারণা তাঁর। তবে সেই ফাঁকটি তিনি খুঁজে পাননি। এর মধ্যে কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন রেশমা। জ্ঞান ফেরার পর আল্লাহর নাম জপেছেন। শেষ সময়ে আর নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। কাল হঠাৎ উদ্ধারকারীদের তৈরি একটি ফাঁক গলে আলো এসে পড়ে তাঁর পাশে। এরপর বাঁচার তাগিদে সাহায্য চাইতে উঠে দাঁড়ান রেশমা। একটি লাঠিতে কাপড়ের টুকরো বেঁধে ওই ফাঁক দিয়ে বাইরে বের করে নাড়ান। তবে সেদিকে কেউ আছে কি না তা তিনি তখনো জানতেন না। কিছু সময় পর যন্ত্রের শব্দ তাঁর কানে যায়। দেখা মেলে উদ্ধারকারীদের। রেশমা জানান, নামার সময় তিনি পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছেন। এ ছাড়া দুর্বলতার কারণে তিনবার তিনি পড়েও গেছেন। বেশ কিছু সময় পর নিজের চেষ্টাতেই উঠে দাঁড়ান রেশমা।যেভাবে সন্ধান - গতকাল ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৩টা ২৫ মিনিট। রানা প্লাজার সামনের দিকটায় ভেকুর সাহায্যে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। হঠাৎ একজন উদ্ধারকারী চিৎকার করে ওঠেন, 'স্যার, জ্যাতা মানুষ দেখা যায়- এইখানে আসেন। মেশিন বন্ধ করেন।' রেশমাকে প্রথম দেখা ওই যুবকের নাম মোহাম্মদ রুবেল, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ড্রামট্রাক চালক। রুবেলের চিৎকার শুনে এগিয়ে যান সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার আবদুর রাজ্জাক। তিনি জমে থাকা পানির পাশে দালানের নিচের অংশের ফাঁক দিয়ে একটি লাঠি নড়তে দেখেন। এগিয়ে গিয়ে তিনি দেখেন, দূরে দুটি চোখ দেখা যাচ্ছে। রাজ্জাক শুনতে পান তাঁর উদ্দেশে বলা হচ্ছে, 'স্যার, আমাকে বাঁচান। পানি দেন, খাবার দেন।' রাজ্জাক ছুটে যান সেখানে দায়িত্বরত মেজর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মেজর দেলোয়ার হোসেনের কাছে। এই দুই সেনা কর্মকর্তা তখন উদ্ধারকাজের পর্যায় ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককে। অবিশ্বাস্য খবরটি পেয়ে দুই সেনা কর্মকর্তা ছুটে যান। স্বজনরা জানিয়েছেন, রেশমার বাবা মৃত আনসার আলী। মা জবেরা খাতুন। বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার তুষগাড়ি গ্রামে। রেশমার স্বামীর নাম আবদুর রাজ্জাক। তাঁদের বাড়ি যশোরের মণিরামপুরে। তাঁরা সাভারে ব্যাংক কলোনি এলাকায় থাকতেন। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে রেশমা সবার ছোট। তাঁকে ফিরে পেয়ে স্বজনরা এখন আনন্দাশ্রুতে ভাসছেন। বড় বোন আসমা কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৭ দিন হাতে ছবি নিয়া বোনরে খুঁজতাছি। মনে করছি মইরাই গেছে। লাশের জন্য মাঠে বইসা থাকছি। মর্গে গেছি। বাঁইচা আছে শুইনা কলিজাটা এখন কেমন জানি লাগতাছে। আল্লাহ রহমত করছে।' বোনকে দেখে আইসিইউ থেকে বের হয়ে এসে তিনি বলেন, 'ও আমারে চিনতে পারছে। ও বলছে, এইটা আমার বড় বোন। ও ভালো আছে।'
সন্ধ্যায় রেশমাকে দেখতে সাভার সিএমএইচে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও রেশমাকে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি উদ্ধারকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে দেশবাসীকে দোয়া করার আহবান জানান। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন : রেশমাকে উদ্ধারের পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক অভিনন্দন বার্তায় বলেন, উদ্ধারকারীরা অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রপতি রেশমার দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। 

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor