কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের হাতিমারা গ্রামটির চিত্র এক দিনের ব্যবধানে একেবারে পাল্টে গেল। গত শনিবার দুপুরে মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া বাজারের উত্তর পাশে ঘাতক ট্রাক কেড়ে নেয় হাতিমারা গ্রামের সাতটি নিষ্পাপ তাজা প্রাণ। নিহতরা সবাই স্থানীয় নাথেরপেটুয়া মডেল স্কুলের (কিন্ডারগার্টেন) শিক্ষার্থী। এলাকাবাসীর ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘাতক ট্রাকটির পাশে দাঁড়িয়ে গতকাল সকালে কাঁদছিল নিহত শোভা, হৃদয় ও মিথুনদের খেলার সঙ্গীরা। তারা তাদের বন্ধুদের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ট্রাকটির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। নিহত শিশুদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে মাতম। নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। শুধু হাতিমারা নয়, এ শোক যেন উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় উপজেলা পরিষদ তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে। এদিকে শনিবারের সাত শিশু নিহতের ঘটনায় গতকাল থানায় মামলা হয়েছে।ঘটনাস্থলেই নিহত হাসিবুল হাসান নিহাদ (৬) ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্লে গ্রুপের ছাত্র ছিল। ওই দিন সকালে ছেলেকে নিজ হাতে রুটি খাইয়ে স্কুলভ্যানে তুলে দেন হাসিনা বেগম। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে নিহাদ ছিল সবার ছোট। বড় বোন তাহমিনা আক্তার (১৫) প্রতিবন্ধী। অন্য দুই বোন ওই স্কুলেই পঞ্চম ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
ঘটনাস্থলেই নিহত ফাহাদুল ইসলাম মিথুন (৯) ছিল তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। মা নাসিমা বেগম ওই দিন সকালে ছেলেকে তার বাবা মাহবুবুল ইসলামের সঙ্গে নাশতা খাইয়ে স্কুলভ্যানে তুলে দেন। মিথুন বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল বলে তার মা বিলাপ করছেন।
একই অবস্থায় নিহত আরেক হতভাগ্য টিপু সুলতান স্বাধীন (১০) ছিল চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বাবা সেলিম মিয়া বাইরাইনপ্রবাসী। ওই দিন সকালে নাশতা খাইয়ে টিফিনের জন্য পাঁচ টাকা হাতে দিয়ে ছেলেকে স্কুলভ্যানে তুলে দেন মা সুরমা বেগম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছেলে বলেছিল, 'আম্মু টা-টা আসি।' ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে কিছুক্ষণ পর পর অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তিনি। স্বাধীনের একমাত্র ছোট বোন সুমাইয়া সুলতানা শান্তা ভাইকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ। তার ধারণা, ভাইয়া আবার ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফিরবে।
হাসপাতালে নেওয়ার পর প্রথমে ঝরে যায় রাকিবুল হাসান শুভর (৬) প্রাণ। সে প্লে গ্রুপের ছাত্র ছিল। তার বাবা মনির হোসেন ওমানপ্রবাসী। মা লাকি বেগম ছেলের শোকে পাথর। দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভ বড়।
হাসপাতালে নেওয়ার পর নিহত আল-আমিন (৬) নার্সারিতে পড়ত। বাবা মাওলানা আবদুল মালেক ছেলে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ। আর মা আয়েশা আক্তারের বিলাপে কাঁদছে সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশীরাও। দুই ভাইয়ের মধ্যে আল-আমিন বড়। অবুঝ শিশু আরাফাতের প্রশ্ন, তার ভাইয়া কখন বাড়ি ফিরবে। নিহত মোত্তাকিন হোসেন হৃদয় (৬) ছিল প্লে গ্রুপের ছাত্র। হাসপাতালে নেওয়ার পথে প্রাণ হারায় সে। তার বাবা মো. আবদুল্লাহ ও মা রুনু আক্তার ছেলের শোকে পাথর। দুই ভাইবোনের মধ্যে হৃদয় বড়, ছোট বোনের নাম নিহার আক্তার।
হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যাওয়া জান্নাতুল মাওয়া শোভা (৭) পড়ত নার্সারিতে। বাবা জহিরুল ইসলাম মজুমদার সৌদিপ্রবাসী। গত মাসে ছুটিতে বাড়ি আসেন তিনি। দুই বোনের মধ্যে শোভা বড়। ছোট্ট নুশরাত জাহান বড় বোনের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে।
মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা আমিরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের স্কুলের ভ্যানটি রাস্তার বাঁ পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ নোয়াখালীগামী ঘাতক ট্রাকটি স্কুলভ্যানটি অতিক্রমের সময় তা চাপা দেয়। আমরা প্রশাসনের কাছে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই।'
এদিকে গতকাল সকালে নিহতদের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে হাতিমারা গ্রামে আসেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াছ পাটোয়ারী। তিনি উপজেলা পরিষদ ও মনোহরগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে তিন দিনের শোক পালনের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাচ ধারণ করতে সবার প্রতি আহবান জানান। নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাসও দেন তিনি।
মনোহরগঞ্জ থানার ওসি মো. জহিরুল আনোয়ার বলেন, ঘাতক ট্রাকটির চালক ও মালিককে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার দুপুরে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া বাজারের অদূরে ঘাতক ট্রাকের চাপায় স্কুলভ্যানে থাকা সাত শিশু শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত শিশু ফাহমিদা তাহের তমা, খাজিদা আক্তার যুথী ও ভ্যানচালক জয়নাল আবেদীন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে সাতটি কচি প্রাণ। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া রিকশা-ভ্যানের অস্তিত্বও বোঝা কঠিন। কিন্তু রিকশা-ভ্যানের 'আম্মু টা টা আসি' লেখাখচিত অংশটি রয়ে গেছে অক্ষত। এ যেন মাকে চিরবিদায়ের ডাকে চলে যাওয়া। শিশুদের অন্তিম উচ্চারণ তাদের মায়ের উদ্দেশে।
No comments:
Post a Comment