তাঁদের মৃত্যুতে রাজধানীর সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বেপরোয়া চালকদের হাতে আর কত প্রাণ পথে পিষ্ট হবে, কতজনকে চলে যতে হবে অকালে—এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছিল সবার মনে। ওই দুর্ঘটনায় আরও তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী দিলারা বেগম জলি। আহত তিনজনকে ঢাকার পান্থপথের বেসরকারি স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এক সপ্তাহের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
তাঁর নতুন চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর শুটিংয়ের স্থান দেখতে তারেক মাসুদ মিশুক মুনীরসহ সহকর্মীদের নিয়ে গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জে। ফেরার পথে গতকাল দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের জোকা নামক স্থানে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির একটি বাসের সঙ্গে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসের নয় আরোহীর মধ্যে পাঁচজনই ঘটনাস্থলে মারা যান। নিহত অন্য তিনজন হলেন—সেট ডিজাইনার জামাল হোসেন (৩৫), কর্মী ওয়াসিম (৪৫) ও গাড়ির চালক মোস্তাফিজুর রহমান (২৫)।
ঘটনার বর্ণনা: প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, বেলা পৌনে একটার দিকে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নয় সহকর্মীকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ-১৩-০৩০২) মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকায় পৌঁছায়। এ সময় ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গাগামী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো ভ-১৪-৪২৮৮) সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে যাত্রীরা সবাই মাইক্রোবাসের ভেতরে আটকা পড়েন। বিকট শব্দ শুনে পাশের বিভিন্ন বাড়ির লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাঁরা মাইক্রোবাস থেকে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ঘিওর থানাকে ঘটনা জানান। পুলিশের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে এসে মাইক্রোবাস থেকে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন। উদ্ধারের পর দেখা যায়, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মারা গেছেন। মাইক্রোবাসে থাকা কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক মনীষ রফিক সৌভাগ্যক্রমে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান। বাকি তিনজন গুরুতর আহত হন।
পরে মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ ঢাকায় নেওয়া হয়।
আহতদের মধ্যে ক্যাথরিন মাসুদ ও ঢালী আল মামুনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা দুজনই সংজ্ঞাহীন ছিলেন। চিকিৎসকেরা জানান, ৪৮ ঘণ্টা পার না হলে তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে দিলারা বেগম জলির অবস্থা উন্নতির দিকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: মাইক্রোবাসের যাত্রী মনীষ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। চালকের পাশের আসনে বসে ছিলেন তারেক মাসুদ। বাকিরা পেছনের আসনে ছিলেন। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে আসা একটি বাসের সম্মুখভাগ মাইক্রোবাসের চালকের আসন বরাবর ঢুকে যায়।’ ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের জন্য মূর্ছা যান। সংবিৎ ফিরে পেলে দেখতে পান, আশপাশের আসনে বসা তারেক মাসুদসহ পাঁচজন নিথর হয়ে গাড়িতে পড়ে আছেন। অন্য তিনজন রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। গাড়িটি এমন দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল যে তিনি তাঁদের উদ্ধার করতে পারেননি। এরপর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
ঘটনাস্থল-লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দা ব্যোমকেশ সরকার বলেন, ‘আমি ঘরের বারান্দাতেই ছিলাম। আচমকা বিকট শব্দ কানে আসে। সোজা রাস্তার দিকে দৌড় দিই। গিয়ে দেখি, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বড় একটি মাইক্রোবাসের ভেতরে কয়েক ব্যক্তি আটকে আছেন। গাড়ির ভেতর থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় পড়েছে। তা বৃষ্টির পানি মিশে পুরো রাস্তা লাল হয়ে গেছে। গাড়ির দরজা ভেঙে ঝুলে আছে। গাড়ির ভেতর লাশগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। রক্তাক্ত অবস্থায় তিন-চারজন কাতরাচ্ছেন।’
ব্যোমকেশ বলেন, ‘গাড়ি থেকে আমি লাশ টেনে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়িতে সবাই আটকে পড়ায় কাউকে বের করা যায়নি।’
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ সরকার জানান, ব্যোমকেশের সঙ্গে তাঁরা আরও চার-পাঁচজন চেষ্টা করেও লাশ বের করতে পারেননি। এরই মধ্যে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস এসে হতাহতদের উদ্ধার করে।
গাড়িটি পথের ওপর থাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উভয় দিকে যানবাহনের লম্বা সারি পড়ে যায়। পরে পুুুলিশ এসে দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি রেকার দিয়ে সরিয়ে নিলে যান চলাচল শুরু হয়।
গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা মাইক্রোবাসটি রাস্তার পাশে পড়ে আছে। রাস্তার ওপর টুকরো টুকরো হাড়, মজ্জা এবং ল্যাপটপ ও ক্যামেরার ভাঙাচোরা অংশ ছড়িয়ে আছে। রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, বৃষ্টিতেও যা পুরোটা মুছে যায়নি। কৌতূহলী মানুষ দুর্ঘটনাস্থলে ভিড় করে আছেন।
ঘিওর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রইচ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাসটির চালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। বাসটি আটক করে বরঙ্গাইল হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাইক্রোবাসটি মানিকগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। ওসি জানান, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না দিলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
তারেক মাসুদের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান অডিওভিশনের প্রোডাকশন ম্যানেজার মো. আসাদ খান জানান, গতকাল সকালে তারেক মাসুদ, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদসহ ১০ জন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ইছামতী নদীর তীরে রূপসা সালজানা গ্রামে কাগজের ফুল নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য শুটিং লোকেশন দেখতে যান। এক ঘণ্টা ধরে শুটিং স্পট তত্ত্বাবধানের পর তাঁরা মাইক্রোবাসে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
আসাদ জানান, তিনিও মাইক্রোবাসে ফিরছিলেন। তবে সালজানা পাকা রাস্তার মোড়ে এসে তারেক মাসুদ তাঁকে নামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি থাকো শুটিং লোকেশন তত্ত্বাবধানের জন্য।’ এরপর তিনি শুটিং স্পটে ফিরে গোসল করতে যান। গোসল শেষ হওয়ার পর তাঁর মোবাইলে ফোন আসে, তারেক মাসুদকে বহনকারী গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এরপর তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
হাসপাতালের দৃশ্য: তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুতে তাঁদের সহকর্মীসহ গণমাধ্যমের কর্মীরা ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ ছুটে যান। সেখানে সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে কান্নার রোল পড়ে যায়। আসাদ খান বিলাপ করছিলেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই স্যারের সঙ্গে ছিলাম। আর এখন তাঁকে চেনা যায় না। আমার স্যারের মতো মানুষ আর ফিরে আসবে না!’
আসাদ খান বলেন, ‘মাত্র পাঁচ দিন আগে স্যারের বাবা বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর স্যার বলতেন, “আমার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। তবু আমি পিছপা হব না। দেশ নিয়ে ছবি বানাব। কোনো বাণিজ্যিক ছবি করব না।” তিনি বলেন, ‘স্যার খুব সতর্ক ছিলেন। সব সময় চালককে ৪০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চালাতে বলতেন। এত সতর্ক থেকেও আজ তাঁকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হলো।’
কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক মনীষ রফিক জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে শুটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ’৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি নিয়ে কাগজের ফুল ছবি নির্মিত হচ্ছিল।
রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তারেক মাসুদের মরদেহ তাঁর ফার্মগেটের মণিপুরীপাড়ার বাসায় এবং মিশুক মুনীরের লাশ বনানীর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। স্বজনদের দেখার পর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হিমঘরে তাঁদের লাশ রাখা হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানান, আজ রোববার সকাল আটটার দিকে মিশুক মুনীরের লাশ তাঁর কর্মস্থল এটিএন নিউজের কার্যালয়ের সামনে নেওয়া হবে। এরপর সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মরদেহ সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। সেখান থেকে তাঁদের লাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে নেওয়া হবে। সেখানেই তাঁদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ আরও জানান, মিশুক মুনীরের ভাই ভাষণ মুনীরের আগামী মঙ্গলবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি ফিরলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে মিশুকের দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তিনি শঙ্কামুক্ত হলে এবং তাঁর মা ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে মাসুদের দাফনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই মৃত্যু আমাদের বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। এই দুজনই সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ধারা শুরু করেছিলেন তারেক। আর মুনীর টিভি সাংবাদিকতায় নতুন ধারা শুরু করেছিলেন। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।’
শোক: তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পৃথক শোকবাণী দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment