April 26, 2011

স্ত্রীকে পিটিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে অমানুষ রেজাউল


ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন নাদিয়া। পেয়েছিলেন স্বামী। তবে সে স্বামী স্বামী নয়, স্বামী নামের এক অমানুষ। পাষণ্ড, পিশাচ, নৃশংস, নিষ্ঠুর- কোন বিশেষণই যথেষ্ট নয় তার জন্য। স্বামী নামের ওই ঘাতকের ক্ষিপ্ত আক্রোশের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন নাদিয়া। স্বামী রাজার নির্মম পিটুনির ক্ষতচিহ্ন সর্বাঙ্গে নিয়ে লাশ হয়েছেন তিনি। আর সে লাশ নিয়েও ক্রূরতার শেষ ছিল না। বরিশালে নিয়ে যাওয়ার জন্য মতিঝিল থেকে শাহবাগ- রাজধানীর পথে পথে গাড়িতে সেই লাশ নিয়ে ঘুরেছে রাজা নামের ওই ঘৃণিত জীব।

বরিশাল শহরের একটি বাড়িসহ অর্ধ কোটি টাকার সম্পত্তির লোভ এবং রাজার নারীঘটিত বিষয়গুলোই কাল হয়েছিল সৈয়দা কামরুন নাহার নাদিয়ার। বিয়ের পর থেকেই বরিশালের বাড়িসহ তার পৈতৃক ৫০ লাখ টাকার সম্পত্তি লিখে দিতে চাপ দিতে থাকে স্বামী শিকদার শফিকুর রহমান ওরফে রেজাউল ওরফে রাজা। হুমকি দেয়া হয় তার ভাই সুজনকেও। রাজার বিরুদ্ধে রয়েছে নারী পাচারের অভিযোগ। বিয়ে করেছে একাধিক। নিজের পিতা হত্যার অন্যতম আসামিও সে। সব কিছু গোপন করে মাস ছয়েক আগে প্রেমের অভিনয় করে বিয়ে করে নাদিয়াকে। বিয়ের পর নাদিয়া জানতে পারে রাজার সকল কাহিনী। এ নিয়ে শুরু হয় কলহ। এর জের ধরেই রোববার নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নাদিয়াকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন। সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী- তার মাথার বামপাশে ফোলা জখম। বাম গালে রক্তযুক্ত লালা। বাম হাতে কালো কালো জখম। ডান হাতের তালু ও আঙুলের জখম নীল বর্ণ। বুকে কালো জখম। পিঠের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। কোমরের পেছন ও ডান পাশে দাগ। ডান পায়ের হাঁটুর উপর নিচ এবং পায়ের গোড়ালিতে কালো জখম। বাম পায়ের উরু, হাঁটু, নলা ও গোড়ালিতে জখম। উভয় পায়ের পাতা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। পাষণ্ড স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করলেও স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কারের লোভ ছাড়তে পারেনি। হত্যার পর নাদিয়ার শরীর থেকে খুলে নিয়েছে সব অলঙ্কার। বাসায় তালা লাগানোর আগে তার ব্রিফকেসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে ঢোকানো হয় এসব। মতিঝিলের একটি ব্যাংকে থাকা প্রায় ৭০ হাজার টাকাও উঠিয়ে নেয়া হয় রাজধানী ছাড়তে। তার ব্রিফকেস থেকে পুলিশ উদ্ধার করে নগদ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। উদ্ধার করা হয় ১ ভরি ১৫ আনা ৪ রতির দু’টি চুড়ি। ৫ আনা ২ রতির ১টি আংটি, ২ ভরি ২ আনা আড়াই রতির ৩টি চেইন, ৯ আনা ৫ রতির ৪টি কানের দুল এবং দু’টি নাকফুল। এর মধ্যে নাকফুল এবং কানের দুলের মূল্য ২ লাখ টাকা। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজার মা নূরজাহান বেগম (৬২) ও জুয়েল (২৮) জড়িত বলে পুলিশ ও নাদিয়ার স্বজনরা জানান। রাজার গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী থানার সুন্দদী গ্রামে। পিতা হাবিবুর রহমান শিকদার হত্যা মামলাসহ গৌরনদী থানায় রাজার বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। নাদিয়ার গ্রামের বাড়ি একই জেলার কোতোয়ালি থানার উত্তর কাউনিয়ায়। উভয়ে বনানীস্থ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী। এখানেই পরিচয় দু’জনের। সুন্দরী নাদিয়াকে ফুঁসলিয়ে গত বছরের অক্টোবরে পালিয়ে বিয়ে করে রাজা। নাদিয়ার ভাই শরীফ আহমেদ শাহরিয়ার সিরাজী সুজন বাদী হয়ে রাজার মা নূরজাহান এবং ভাই জুয়েলকে আসামি করে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৩২।

হাজারীবাগ থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তারকৃত রাজা খুব ধূর্ত প্রকৃতির। সে অতীতে অনেক নারীর স্বাদ নিয়েছে। নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। সম্ভবত নাদিয়ার স্বাদ নেয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। লোভ ছিল নাদিয়ার সম্পত্তির প্রতি। অন্য নারীদের প্রতি রাজার আকর্ষণ এবং নাদিয়ার পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার লোভের জন্যই এ হত্যা ঘটানো হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে কিছু তথ্য দিয়েছে। মারধরের কথা স্বীকার করেছে। ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও রফিকুল ইসলাম জানান। খাটের স্ট্যান্ড দিয়ে নাদিয়ার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়েছে বলে রাজা পুলিশকে জানান। আদালতে জবানবন্দিতে রাজার গাড়িচালক রবিউল জানান, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে রাজার মা ও ভাই সহায়তা করেছে। ঘটনার পর তার মা ও ভাই বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর আমাকে ডেকে আনা হয় বাসায়। বলা হয়, তোর ভাবী অসুস্থ। হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেয়ার কথা বলে লাশ গাড়িতে ওঠানো হয়। এরপর রাস্তায় এসে রাজা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে একটি লোকাল বাসে উঠে পড়ে। আমি ওই লোকাল বাসের পিছু নেই। মতিঝিলে এসে তাকে ধরি। সে জানায়, ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে এসেছি। আমি বলি, সেটা আমাকে বলে আসতে পারতেন। রোগীকে গাড়িতে একা রেখে এভাবে চলে এলেন কেন? এরপর টাকা ওঠানো পর্যন্ত আমি মতিঝিলে আপেক্ষা করি। টাকা ওঠানোর পর আমাকে জানায়, তোর ভাবী মারা গেছে। আমি বলি, তাহলে ভাবীর ভাইকে ফোন করুন। সে বলে, লাশ বরিশাল নিয়ে যেতে হবে। আমি এতে রাজি হইনি বলে নাদিয়ার লাশ বরিশাল নিতে পারেনি।

নাদিয়ার ভাই সুজন জানান, রাজার স্বভাব চরিত্র ন্যক্কারজনক। বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে সে কুকর্মে লিপ্ত ছিল। এতে বাধা সৃষ্টি করে নাদিয়া। ফলে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় উভয়ের মধ্যে। এর মধ্যেই আমার পৈতৃক সম্পত্তি দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে রাজা। রোববার সকাল ১০টার পর থেকে দিনের বেশির ভাগ সময় রাজা ও নাদিয়ার মোবাইল ফোন বন্ধ পাই। তারা কোথায় আছে তা জানতে আমি ব্যাকুল হয়ে পড়ি। যখন রাজা ফোন ধরে তখন তার অবস্থান একেকবার একেক জায়গার কথা বলে। বিকাল ৪টার দিকে বলে আমি গাড়িসহ শাহবাগ এলাকায় আছি। তখন আমি আমার ভাগ্নে রাজিব ও বন্ধু সিজারকে নিয়ে শাহবাগের দিকে রওনা হই। সন্ধ্যার দিকে শাহবাগ শিশু পার্কের গেটে ট্রাফিক সিগনালে রাজার গাড়ি দেখতে পাই। আমরা গাড়ির কাছে গেলে রাজা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পথচারীদের সহায়তায় আমরা তাকে ধরে ফেলি। গাড়ির ভেতরে আমার বোন নাদিয়াকে অসুস্থ রোগীর মতো বসানো অবস্থায় দেখি। তাকে ডাক দিলে দেখি কোন সাড়াশব্দ নেই। শরীরে হাত দিয়ে দেখি নাদিয়া অচেতন। বুঝতে পারি নাদিয়া মারা গেছে। আমি অবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকি। খবর দেই আত্মীয় স্বজনদের। তারা পুলিশসহ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশ ও স্বজনদের সহায়তায় নাদিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সুজন জানান, নাদিয়াকে হাজারীবাগের রায়েরবাজারস্থ ৯০/এ হাতেমবাগের দোতলার বাসায় সকাল ৮টার পর হত্যা করা হয়েছে। পরে তার লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে বরিশালে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। গাড়িচালকের আপত্তি থাকায় রাজা তা পারেনি। পরে লাশ নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রাইভেটকারে করে ঘুরেছে।

নাদিয়ার খালাতো বোন নাজনীন আক্তার জানান, রাজা নারী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। নাদিয়ার পরিবারের সম্পত্তির প্রতি তার লোভ ছিল। অন্য মেয়েদের সঙ্গে ছিল তার অবৈধ সম্পর্ক। এসব কারণে প্রায়ই নাদিয়াকে নির্যাতন করা হতো। গতকাল দুপুরে হাসপাতালের মর্গে দাঁড়িয়ে থাকা মানবাধিকার কর্মী লিগ্যাল এডভোকেসি অ্যান্ড লবি-র পরিচালক এডভোকেট মাসুদা আক্তার জানান, এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। এর সঙ্গে নারী নির্যাতন এবং যৌতুকের ধারা সংযুক্ত করে মামলা পরিচালনা করতে হবে। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে যা করা দরকার আমরা সবই করবো।

সোমবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিহত নাদিয়ার লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক প্রভাষক আবুল খায়ের কোন মন্তব্য করতে চাননি। তবে ফরেনসিক বিভাগের একজন কর্মচারী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, নাদিয়ার সারা শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। হাত ও পায়ের জখম সবচেয়ে বেশি। নাদিয়াকে পেটানো হয়েছে। এর ফলে তার মৃতু্য ঘটেছে। ময়নাতদন্তের পর নাদিয়ার লাশ মর্গ থেকে দাফনের জন্য নিয়ে যান তার স্বজনরা। মর্গে উপস্থিত ছিলেন নাদিয়ার ভাই সুজন, খালাতো বোন নাজনীন চৌধুরী ও মামাতো ভাই ওসমান সাইদ। তারা সবাই এক বাক্যে বলেছেন, প্রতারণা করে নাদিয়াকে বিয়ে করে শফিকুর রহমান। বিয়ের পর থেকেই তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।

পুলিশ বলেছে, শনিবার রাতেই শফিকুর রহমান তার স্ত্রী নাদিয়াকে তার রায়েরবাগের হাতেমবাগ লেনের বাড়িতে লাঠি দিয়ে প্রহার করে। এ সময় শফিকুরের মা ও ভাই ওই বাড়িতে উপস্থিত ছিল। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করায় তাদেরও এজাহারের আসামি করা হয়। শাহবাগ থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাইভেট কারে মৃতদেহটি শাড়ি পরানো অবস্থায় এমনভাবে রাখা হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছে আরোহী নাদিয়া পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন সিটের একপাশে। এদিকে গতকাল বিকালে বাসাবো খেলার মাঠে নিহতের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় আজিমপুর কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor