দিল্লি শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার জন্য প্রণব মুখার্জি গতকাল বিকেলে ঢাকায় আসেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ভারতের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের (প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা) ঋণসহায়তা চুক্তি সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
ভারতের ঋণসহায়তার ব্যাপারে বাংলাদেশের বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে প্রণব বলেন, চুক্তির শর্ত বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। কোনো দেশকে দেওয়া ভারতের এটাই সর্বোচ্চ ঋণ। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘চুক্তিটি সই করায় তারা (বিরোধী দল) আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। কিন্তু এ চুক্তির সঙ্গে এডিবির চুক্তির শর্তের তুলনা হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়।’
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দুই প্রতিবেশী দেশের অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঋণসহায়তা চুক্তি সই হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। ভারতের পক্ষে সই করেন এক্সিম ব্যাংকের (এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া) চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক টি সি এ রঙ্গনাথন। চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে ২০ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও পাঁচ বছর বাড়তি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) পাবে। এ ছাড়া ঋণের কমিটমেন্ট ফি (সুদের পাশাপাশি ঋণের জন্য দেওয়া বাড়তি অর্থ) ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। ঋণের আওতায় প্রকল্পের চুক্তি অনুমোদনের এক বছর পর থেকে অব্যবহূত ঋণের জন্য এই হার ধরা হবে।
নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি বলেন, এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে নেপালের পণ্যবাহী ট্রাক যাতে বাংলাদেশে আসতে পারে, সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।অর্থমন্ত্রী মুহিত এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার সুযোগ আছে বাংলাদেশের। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কিংবা এশিয়ায় ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া দেশগুলোর সেরা হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ দমনে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ার দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কে চিড় ধরাতে সক্রিয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারত উন্নয়নের যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, দুই দেশ সরকারি-বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করে তা অর্জন করতে পারে। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রাধিকার ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে ভারত বদ্ধপরিকর। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশে খাদ্যশস্য রপ্তানির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন। প্রণব মুখার্জি বলেন, ভারতে খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনা করে তিন লাখ টন চাল ও দুই লাখ টন গম রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের স্বার্থে দিল্লি শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির মধ্যে বৈঠকের সময় দুই পক্ষ এ বিষয়ে একমত পোষণ করে। প্রণব মুখার্জি গতকাল বেলা তিনটা ৪০ মিনিটে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সফরের শুরুতে তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি ভারতের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা চুক্তি সই অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
সফরের শেষ কার্যসূচি অনুযায়ী প্রণব মুখার্জি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা গত জানুয়ারিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যৌথ ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন। এ ছাড়া নেপাল, ভুটানকে সংযুক্ত করে আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ব্যাপারেও বৈঠকে আলোচনা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ এবং ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়েও দুই নেতা আলোচনা করেন। এরপর তিনি ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসভবনে যান। সেখানে আওয়ামী লীগের তিন জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে জানা গেছে। রাত সাড়ে নয়টায় তিনি দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় ঋণের আওতায় যে ১৪টি প্রকল্প অনুমোদন করেছেন, সেগুলোর মধ্যে ১০টি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এবং অন্য চারটি পানিসম্পদ, নৌপরিবহন, বিদ্যুৎ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন করা হবে। রেলওয়ের যে পাঁচটি প্রকল্প অনুমোদন হচ্ছে, তার চারটি সরঞ্জাম কেনা এবং অন্যটি সেতু নির্মাণসংক্রান্ত। প্রকল্পগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৮ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এই প্রকল্পগুলো হচ্ছে ১০টি নতুন ইঞ্জিন কেনা, ১২৫টি যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহ, জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ৬০টি ব্রডগেজ ট্যাংক ওয়াগন ও দুটি বগি ব্রেক ভ্যান সংগ্রহ, কনটেইনার পরিবহনের জন্য ৫০টি মিটারগেজ ফ্লাট ওয়াগন বগি ও পাঁচটি ব্রেক ভ্যান সংগ্রহ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জে দুটি রেলসেতু নির্মাণ।যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো হচ্ছে বিআরটিসির জন্য ৩৫০টি বাস কেনা, সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-চিনাইর-আখাউড়া-সোনারদী স্থলবন্দর সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা, জুরাইন রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর সংযোগ সড়ক উন্নয়ন। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌবন্দর স্থাপন, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভেড়ামারা-বহরমপুর সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএসটিআইর পরীক্ষণাগারের আধুনিকায়ন।এখানে যে ১৪টি প্রকল্প বিবেচনাধীন রয়েছে, তার প্রাক্কলিত ব্যয় ৬১ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভারতের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তার আওতায় আরও ৩৯ কোটি ডলারের নতুন প্রকল্প নেওয়া যাবে।
No comments:
Post a Comment