July 7, 2010

জাহাঙ্গীরনগরে ভয়ংকর ছাত্রলীগ

মারধরের পর ফেলে দেওয়া হয় হলের ছাদ থেকে। আলবেরুনী হলের পাশে নিথর পড়ে আছেন আহতদের কয়েকজন।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে একজন সহকারী প্রক্টরসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্যের পক্ষের নেতা-কর্মীরা এ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের সময় কয়েকজনকে মারধরের পর ফেলে দেওয়া হয় ৪ তলা হল ভবনের ছাদ থেকে। সংঘর্ষ থামাতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীর ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. আরজু মিয়াকেও লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৭ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। ঘটনা তদন্তে উপ-উপাচার্য ড. ফরহাদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠন থেকে ১৩ ছাত্রলীগকর্মীকে বহিষ্কার করেছে। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রমও স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।গতকাল সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবেরুনী হলে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে তা পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষ প্রায় ২০টি গুলি ছোড়ে। আহতদের তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি পক্ষের আলবেরুনী হলের ছাত্রলীগকর্মী কাজী মুস্তফা মনোয়ার সজীব হল থেকে তাঁর নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যাওয়ার উদ্দেশে বের হন। তিনি ক্যাম্পাসের পরিবেশবিজ্ঞান ভবনের সামনে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মী একই হলের এনায়েত কবীর এ্যামিলের (বাংলা বিভাগ) জুনিয়র কর্মীরা তাঁকে রড, লাঠি, হকিস্টিক, রামদা ও চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে নেওয়া হলে চিকিৎসকদের সামনে আবারও এ্যামিল গ্রুপের ক্যাডাররা রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় মেডিক্যাল সেন্টারের নার্স মাহমুদা পারভিন লাঞ্ছিত হন।

সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে : এ সংঘর্ষের খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সজীবের ওপর হামলার প্রতিশোধ নিতে মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে সভাপতি পক্ষের বিভিন্ন হলের কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, রড, লাঠি ও রামদা নিয়ে একত্রিত হয়। সেখান থেকে তারা আলবেরুনী হলের দিকে অগ্রসর হলে হলের মূল ফটকে তালা দিয়ে আত্দরক্ষা করার চেষ্টা করে সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীরা। এ সময় সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খবর পেয়ে সেখানে যান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীর ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. আরজু মিয়া। এ সময় উপাচার্য সজীবের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের। কিন্তু তারা উপাচার্য ও প্রক্টরের কথা না শুনে হলের মূল ফটকের তালা ভাঙতে শুরু করে। তালা ভাঙতে বাধা দিতে গেলে তাঁদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। উপাচার্যের উপস্থিতিতেই সাতটি ফাঁকা গুলি চালায় তারা। একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে উপাচার্য তাঁর গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

ছাত্রলীগের ওপরই ছাত্রলীগের বর্বর হামলা : উপাচার্য ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর সভাপতি পক্ষের কর্মীরা তালা ভেঙে হলে ঢুকে প্রতিপক্ষের কর্মীদের এলোপাতাড়ি মারধর করতে শুরু করে। তারা হলের তৃতীয় তলায় উঠে সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীদের মারধর করে জানালা দিয়ে ফেলতে থাকে। সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীরা হলের চতুর্থ তলায় ছাদে আশ্রয় নিলে সেখানেও হামলা চালায় সভাপতি পক্ষের কর্মীরা। এ সময় এ্যামিলসহ সাত-আটজন কর্মীকে পিটিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তারা। প্রক্টরিয়ালবডির সদস্যরা অনেক চেষ্টা করেও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের থামাতে পারেননি।

মারধর চলাকালে সহকারী প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া গুরুতর আহত ছাত্রলীগ কর্মী এ্যামিলকে রিকশায় করে মেডিক্যাল সেন্টারের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা সহকারী প্রক্টর ফিরোজের ওপরও হামলা চালায়। এতে তিনি ডান হাতে আঘাত পান।

আলবেরুনী হলে মারধর চলাকালে গুরুতর আহত হন সাধারণ সম্পাদক পক্ষের রিয়াল (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), জয়ন্ত (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), সোহেল (ইতিহাস), জাহিদ (বাংলা), সকাল (বাংলা), বিজয় (বাংলা), আরিফ (বাংলা), তনয় (পরিবেশবিজ্ঞান), মুন্না (পরিবেশবিজ্ঞান) ও রাজিব (প্রত্নতত্ত্ব)।

একই ঘটনার সূত্র ধরে দুপুর ১টার দিকে সাধারণ সম্পাদক নিয়ন্ত্রিত আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল ও সভাপতি নিয়ন্ত্রিত শহীদ সালাম-বরকত হলের ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি প্রায় ১৩টি গুলি ছোড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ সংঘর্ষে ইতিহাস বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের শিমুল (শহীদ সালাম-বরকত হল) বুকে এবং দর্শন বিভাগের একই ব্যাচের উজ্জ্বল (কামাল উদ্দিন হল) পেটে গুলিবিদ্ধ হন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল ও স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বর্তমানে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যেকোনো মুহূর্তে আবারও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জরুরি বৈঠক ও বহিষ্কার : বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ছাত্রদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভা করে। ওই সভার সুপারিশ অনুমোদনের জন্য সাড়ে সাতটায় জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহবান করা হয়। সিন্ডিকেট সভায় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে উপাচার্য ১৭ জনকে শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেন। এছাড়া ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ফরহাদ হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ঘটনা তদন্ত করে ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। বহিস্কৃত শিক্ষার্থীরা ছাড়া আরো কেউ ঘটনায় জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সিন্ডিকেট সভায় জানানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত ছাত্ররা হলেন রবিউল ইসলাম সূর্য (গণিত), পরিতোষ চাকমা (ফার্মেসি), শাহাদাৎ হোসেন রেজা (প্রত্নতত্ত্ব), রকিবুল হাসান রানা (গণিত), ফয়সাল হোসেন (গণিত), তৌহিদুল ইসলাম জয় (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), রাইসুল হাসান শামিম (নৃবিজ্ঞান), আরেফিন রাবি্ব ছন্দ (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), এস এম কামরান হাসান (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), অভিজিৎ চৌধুরী (দর্শন), আরিফুল হক (বাংলা), তোফাজ্জল হোসেন ইমন (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), মহিউদ্দিন আহমেদ মাহী (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব), বিজয় কুমার দাস (বাংলা), শুভাশিষ কুন্ডু টনি (প্রত্নতত্ত্ব), স্বাধীন (প্রত্নতত্ত্ব) ও সুমন (রসায়ন)।

সংঘর্ষের ব্যাপারে ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন বলেন, সংঘর্ষের ঘটনাটি আলবেরুনী হলের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সংগঠনের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেন।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আরজু মিয়া বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।ছাত্রলীগের ১৩ কর্মীকে বহিষ্কার: অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের খবর পেয়ে গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। পরে সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১৩ কর্মীকে বহিষ্কার করে।

দল থেকে বহিষ্কৃত কর্মীরা হলো কাজী মারুফ সজীব, বিজয় কুমার দাশ, পারভেজ, দেবব্রত প্রিয় জনি, আরিফুল হক আরিফ, খায়রুল বাশার রাজু, শুভাশীষ কুণ্ড টনি, মহিউদ্দিন আহমেদ মুহি, উজ্জ্বল কুমার দাশ, চয়ন, সকাল, স্বাধীন ও পলাশ।গতকাল সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন স্বাক্ষরিত পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। বিশৃঙ্খল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, 'জাহাঙ্গীরনগর ছাত্রলীগের আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যনির্বাহী কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে সে সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। পরে ওই কমিটি বাতিল করে গত ১৯ মে সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্যের নেতৃত্বে নতুন কমিটি করা হয়।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor