আর বিয়ের কথা ভাবছেন না জামিলুর রহমান জামিল। তার মতে, বিয়ের স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন হারিয়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন তিনি। একই অবস্থা কনে রুনার। সারাক্ষণই কেবল বিলাপ করছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই আয়োজন চলছিল পানচিনি (এনগেজমেন্ট) অনুষ্ঠানের। পুরান ঢাকার ৪৩/৩ নম্বর বাসাটির তৃতীয় তলার বামপাশ্বের ফ্ল্যাটে একজন-দুজন করে আত্মীয়স্বজন এসে জড়ো হচ্ছিলেন। গেটের নিচে রান্না চলছে মোরগ-পোলাওয়ের। কনে রুনাকে সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্থানীয় পাহেচান বিউটি পারলারে। সঙ্গে ছিলেন তার বড় বোন রত্না। এদিকে কনের বাড়িতে বর দুবাইপ্রবাসী জামিল আত্মীয়স্বজন নিয়ে পেঁৗছে গেছেন। আরো দুই-একজন স্বজন নিতে ফিরে এসেছিলেন পাশের হোসেনি দালানের নিজবাড়িতে। স্বজনদের নিয়ে আবারো রওনা হয়েছেন হবু শ্বশুরবাড়ির দিকে। এদিকে বিউটি পারলারে শেষে রুনাও বাসায় ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু কেউ আর ফিরতে পারেননি। আগেই সর্বগ্রাসী আগুন তাদের সব নিঃশেষ করে দিয়েছে। নিঃস্ব করে দিয়েছে তাদের দুজনকেও। আগুনের খবর শুনে দৌড়ে বাসার দিকে গিয়েছিলেন রুনা। অন্যদিকে জামিলও। বাসার ভেতরে তখন মা, ভাইবোনসহ সব আত্মীয়স্বজন। কিন্তু ততক্ষণে শেষ। আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছিল দাউদাউ করে। মা, ভাইবোনের নিশ্চিত মৃত্যুর কথা বুঝতে পেরে জ্ঞান হারান রুনা। জামিলেরও একই অবস্থা।
রুনা জানান, বেশ কয়েক বছর আগেই বাবা ওসমান মিয়াকে হারান তিনি। মা, আর দুই ভাইবোন রত্না ও ফয়সালকে নিয়ে তাদের সংসার। ভালোই চলছিল। সর্বনাশী আগুনে এবার মা ফাতেমা বেগম (৪৫) চলে গেলেন। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানে আসা খালা সাজেদা বেগম (৪২) ও আফরোজা বেগম (২৭), খালাতো বোন আনিকা (১৫) ও খালাতো ভাই সিমেলও (১০) আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। এখন আপন বলতে তার একমাত্র ভাই ফয়সাল আর বড় বোন রত্না। রুনার সঙ্গে তারাও বেঁচে গেছেন। আগুন লাগার সময় রত্না ছিলেন তার সঙ্গে পারলারে, আর ফয়সাল ছিল বাসার নিচে।
রুনাদের বেচারাম দেউড়িতে তাদের নিজেদের বাড়ি ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। উঠেছেন ভাড়া বাসায়। বড় ভাই টুকটাক ব্যবসা করেন। আর ব্যাংকে জমিয়ে রাখা বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চলছিল তাদের। আরমানিটোলার নিউ গভ. গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। তারপর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন নিজেই। বধূ সেজে স্বামীর সংসারে সুগৃহিণী হওয়াটাই ছিল তার একমাত্র ধ্যান।
এদিকে রুনার মতো নিঃস্ব হয়েছেন জামিলও। জামিল জানান, প্রায় সাত বছর আগে দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। সেখানকার জাবাল-ই নুর এলাকায় ওরিয়েন্টেশন প্রেসে কাজ করেন। মাসতিনেক আগে দেশে এসেছেন। এবার বিয়ের কাজটি সেরেই তার দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় না থাকায় শুধু পানচিনি করে গতকাল (শুক্রবার) দুবাই ফেরার কথা। কয়েক মাস পর ফিরে এসে বউকে একবারে ঘরে তুলে নেবেন- এমনটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই ভাবনার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তার মা শাহজাদী বেগম (৫৫), ছোট ভাই শিমুল (৩০), শিমুলের শিশুসন্তান কমল (৩), খালা হাবিবা বেগম (৩৫), মামি গুজ্জু (৪৫), আর তাদের কাজের ছেলে জসিম (১৩)। নিহতরা সবাই তখন পানচিনির অনুষ্ঠানের জন্য জামিলের হবু শ্বশুরবাড়ি অবস্থান করছিলেন।
বৃহস্পতিবার সকালে আগুনে পোড়া রুনাদের তৃতীয় তলার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ড্রয়িংরুমের বড় কড়াইতে মোরগ-পোলাও পড়ে আছে। মেঝেতে পানি। ঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে ছাই। বেডরুমের দেয়ালে রক্তের দাগ। ফ্রিজ, আলমিরা, শোকেস, খাট, তোশক সব আগুনে পোড়া। কোনো কোনো জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আবার কোনো জিনিস আধপোড়া হয়ে আছে। কচুপাতা রঙের দেয়ালটা এখন ধোঁয়া ও আগুনে কালো রঙ ধারণ করেছে। মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো কড়ি ও চীনামাটির থালাবাসন। আগুনে পুড়ে পুরো বাড়িটিই যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment