ঘড়িতে তখনো ৩টা বাজেনি। ঢাকার শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের ফটক আটকে ধরে আছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বাইরে অপেক্ষমাণ শতাধিক গণমাধ্যম কর্মী। রয়েছে আনন্দে উদ্বেলিত জনতার ভিড়ও। দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা এক যুবককে তারা প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাবে। ভেতর থেকে খবর পাওয়া গেল সেই তরুণকে বহনকারী বিশেষ বিমান ৪টা ২৫ মিনিটে বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। আরো প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। প্রচণ্ড তাপদাহেও কারো মধ্যে বিরক্তির লেষমাত্র নেই। সাড়ে ৩টার দিকে গণমাধ্যম কর্মীরা একযোগে ভিআইপি লাউঞ্জের ভেতরে চলে যান। আগে থেকেই সেখানে রয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। অপেক্ষার প্রহর শেষে বিশেষ বিমানটি ৪টা ১৫ মিনিটে রানওয়ে স্পর্শ করল। নেমে এলেন এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক মুসা ইব্রাহীম।
সদাহাস্য মুসার এদিনও ছিল গায়ে দেশের লাল সবুজ পতাকা খচিত টি শার্ট। মাথায়ও জড়ানো জাতীয় পতাকা। এভারেস্টের চূড়ায় নিজ দেশের পতাকা উড়ানো 'বীর মুসা' এগিয়ে আসতেই বিমানবন্দরের রানওয়েতে অনেকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। রানওয়ে থেকে ভিআইপি লাউঞ্জের প্রস্থান পথে না এসে দোতলার চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে এগিয়ে যান মুসা। এখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন মুসার মা-বাবাসহ নিকটাত্দীয়রা। ছেলের বিশ্বজয়ের আনন্দে আত্দহারা মা-বাবা সকালে রওয়ানা হয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে এসে পেঁৗছেন। পুত্রকে পেয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিও তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।
চলন্ত সিঁড়ির কাছে আসতেই মাকে জড়িয়ে ধরেন মুসা। এভারেস্ট জয়ের পথে যে ভয়-আতঙ্ক ঘিরে রেখেছিল তা পুত্রকে ফিরে পেয়ে যেন নিমিষেই উবে গেল। আনন্দে মা ছেলের দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। এভারেস্ট বিজয়ী ছেলের ফিরে আসায় বাবা আনছার আলীও খুশিতে আত্দহারা। শ্বশুর শামসুল হক, শাশুড়ি শেহেলী হকসহ স্বজনেরা মুসাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
মা বিলকিস বেগম, বাবা আনসার আলী ছেলে মুসার বিজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আমরা পারিবারিকভাবে এই অভিযানের বিরোধিতা করেছিলাম। তাকে বলেছি, স্ত্রী-পুত্র রেখে জীবনের মায়া ছেড়ে এ সব করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ছেলের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে আমরা হার মানি। আজ মনে হচ্ছে- ছেলে বিশ্ব জয় করেছে। আমরা খুবই খুশি।
এরপরই গণমাধ্যম কর্মীরা ঘিরে ধরে মুসাকে। বিশ্বজয় করে দেশে ফিরেছে মুসা, তার খবর জানাতে তাদের এত ভিড়। ভিআইপি লাউঞ্জের চলন্ত সিড়ির মাঝপথে এসে থেমে যান মুসা। এক হাতে জাতীয় পতাকা, আরেক হাতে বিজয়ের চিহ্ন নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুসা সবার অভিনন্দ গ্রহণ করেন। একের পর এক জ্বলতে থাকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ব্যস্ত হয়ে উঠে টেলিভিশন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। ভিড়, গরম আর হট্টগোল সত্ত্বেও প্রাপ্তির আনন্দে ভাস্বর হয়ে উঠে প্রতিটি মুহূর্ত।
বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয়ীর কাছ থেকে কিছু শোনার আশায় চিৎকার করতে থাকেন সবাই। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মুখ খোলেন মুসা। শোনান বিজয়ের কাহিনী। তিনি বলেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এভারেস্টে পতাকা উড়িয়েছি। এই বিজয়ে আমি যেমন আনন্দিত, তেমনি দেশের মানুষের উষ্ণ অভিনন্দন পেয়ে আপ্লুত। এ বিজয় সারা দেশের, ১৬ কোটি মানুষের। পরে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে মুসাকে নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বের করতে বেগ পেতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের।
এরই ফাঁকে ফাঁকে শুভেচ্ছা বিনিময়, অভিনন্দন আর ছবি তোলার কাজ চলতে থাকে। বিজয়ের মালা গলায় পরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন মুসা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাকে শুভেচ্ছা জানান। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দলের সহ-ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রায়হান আমিন রনি ও সহ-দপ্তর সম্পাদক লতিফুর রহমান জনি তাকে শুভেচ্ছা জানান। দুপুর থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন মুসার সংগঠন নর্থ আলপাইন ক্লাবের সদস্যরা। প্রিয় সহকর্মীর এই বিজয়ে তারা ছিলেন উল্লসিত। ব্যানার-ফ্যাস্টুন, টি-শার্ট গায়ে মুসাকে অভিনন্দন জানান ক্লাবের ২২ সদস্য। এ ছাড়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সংগঠনের পক্ষ থেকেও মুসাকে অভিনন্দন জানানো হয়। এ সময় তার বন্ধুরাও ছিল উচ্ছ্বসিত।
প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি সময় বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে কাটিয়ে মুসা রওয়ানা হন তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান নর্থ আলপাইন ক্লাবের উদ্দেশে। এর আগে মুসা দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ২৩ মে ভোর ৫টায় এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছি। দেশের মানুষের জন্য উল্লাস-আনন্দের সুযোগ করে দিয়েছি। সবার দোয়া ও সমর্থন থাকলে ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আরো এডভেঞ্চার কিছু করতে পারব। এভারেস্ট জয়ে বিপদের মুখোমুখি হয়েছিলেন কিনা_এমন প্রশ্নের জবাবে মুসা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুবার বিপদের মুখে পড়েছিলাম। একবার আট হাজার ফুট উঁচুতে অঙ্েিজন সিলিন্ডারের পাইপ ফুটো হয়ে যায়। এরপর শেরপারা দ্রুত সেটি সেরে দিলে বিপদমুক্ত হই। আরেকবার নামার পথে লাশ দেখে আঁতকে উঠি। মুসা তার এ অভিযানে সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। গত ২৩ মে ভোরে মুসা দেশের পতাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে তুলে ধরে দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনেন। গতকাল স্থানীয় সময় ২টা ২৫ মিনিটে কাঠমান্ডু থেকে দক্ষিণ কোরিয়ান ইয়াংওয়ান গ্রুপের একটি বিশেষ বিমানে তিনি ঢাকা ফেরেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সকালে একই বিমানে তাকে আনতে যাওয়া বড় বোন নূর আয়েশা, ভগি্নপতি ক্যাপ্টেন রাশিদ, স্ত্রী উম্মে সরাবন তহুরা, শিশুপুত্র রাইদ।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ: মুসা ইব্রাহীম গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার এই অসীম সাহসী অভিযানের জন্য অভিনন্দন জানান। মুসা উষ্ণ অভিনন্দনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। নিকটাত্দীয়রা এসময় মুসার সঙ্গে ছিলেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নৈশভোজও করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আব্দুস সোবহান গোলাপ একথা জানান।
ক্যাপ্টেন আহমেদ ইয়াং ওয়ান ফ্লাইট ডিপার্টমেন্টের পরিচালক (অপারেশন ) এবং চিফ পাইলট। ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধুপ্রিয় ক্যাপ্টেন আহমেদ বলেন, মুসার সঙ্গে আমাদের আগে থেকে যোগাযোগ ছিল। তার যে বোনটি মূল স্পন্সর ছিলেন তিনি আমাদের একজন সহকর্মী পাইলটের স্ত্রী। গত দুই-তিন বছর আমরা মুসাকে সমর্থন দিচ্ছিলাম বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট দিয়ে। মুসার এভারেস্ট জয়ের খবরটি আমি আমাদের চেয়ারম্যান কি হাট সাংকে জানাই। তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। আমার মুখে খবর শুনে তিনি খুব আনন্দিত হন। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায় সম্পৃক্ত ইয়াং ওয়ান চেয়ারম্যান বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না বাংলাদেশ এত বড় একটি গৌরব অর্জন করেছে। যাই হোক চেয়ারম্যান মুসাকে স্মরণীয় স্মৃতি দিতে সম্মত হন। দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। ক্যাপ্টেন আহমেদ বলেন, দুই দিন আগে মুসার সঙ্গে কথা হয়। নির্ধারিত সময়ে মুসা চলে আসেন কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে। আমরা তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে যাই। মুসা আবেগআপ্লুত ছিল। তার সঙ্গে আমরাও। আমাদের ৮ সিটের বিশেষ বিমানে করে মুসাকে নিয়ে আসি বাংলাদেশে। এই স্মৃতি আমার জন্যও স্মরণীয়। বাংলাদেশের এক দুর্লভ ইতিহাসের অংশীদার হতে পেরে ভালো লাগছে। আমার সারাজীবনের সেরা ঘটনা মুসাকে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় আনা।
No comments:
Post a Comment