২৮ অক্টোবর ১৯৬৭। দীপালী সিনহার নেতৃত্বে বঙ্গললনা দলের স্বপ্না মিত্র আরোহণ করেন ১৯ হাজার ৮৯৩ ফুট উচ্চতার রোন্টি পর্বত। শুরু হয় বাঙালি পর্বতারোহণের স্বর্ণযুগ, চলতে থাকে একের পর এক অভিযান। গঠিত হয় অনেক পর্বতারোহণ দল আর ক্লাব। বিজিত হতে থাকে অনেক পর্বত চূড়া। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ দশক অধরা থেকে যায় পর্বতারোহণের সবচেয়ে অভিজাত পর্বত শীর্ষচূড়া এভারেস্ট। ১৯৯১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভেরুকা মাউন্টেনিয়ারিং ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রাণেশ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম এভারেস্ট অভিযান। তাতে বাঙালি থাকলেও তারা সেনাসদস্য ছিলেন। সেই অভিযান অবশ্য সফল হয়নি। ১৯৯৩ সালে প্রথম বেসামরিক বাঙালিদের এভারেস্ট অভিযান শুরু হয় অমূল্য সেনের নেতৃত্বে। ১৯৯৫ সালে অতনু চ্যাটার্জির নেতৃত্বে, ২০০১ সালে মিলন নাগের নেতৃত্বে অভিযান হলেও সাফল্য আসেনি নেতৃত্বে কোন্দল, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, দলীয় শৃঙ্খলার অভাব ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কারণে। ফলে বাঙালিদের কাছে অজেয়ই থেকে যায় এভারেস্ট।
অবশেষে সাফল্য আসে সামরিক বাহিনীর এক বাঙালি সদস্য সত্যব্রত দামের পায়ের চড়ে। ২০০৪ সালের ১৯ মে সকাল ১১টায় ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিন কমান্ডার সত্যব্রত দাম এভারেস্টে পা রেখে মর্ত্যের শীর্ষবিন্দুতে আরোহণকারী প্রথম বাঙালি হলেন। যদিও নিজের বাঙালিত্ব নিয়ে বাড়তি কোনো আবেগ অনুভব করেন না জীবনের বেশিরভাগ সময় বাংলার বাইরে কাটানো সত্যব্রত।
এ ঘটনার এক বছর ১৪ দিন পর এভারেস্ট শিখরে পা রাখেন আরেক বাঙালি- এবার বাঙালি ললনা শিপ্রা মজুমদার। চারবার এভারেস্ট জয় করা শেরপা শেরিং দর্জির সহায়তায় ২০০৫ সালের ২ জুন সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শিপ্রা পা রাখেন এভারেস্ট চূড়ায়। তৈরি করেন প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে এভারেস্ট বিজয়ের ইতিহাস।
কমান্ডার সত্যব্রত দাম আর ক্যাপ্টেন শিপ্রা মজুমদার বাঙালিদের মধ্যে প্রথম এভারেস্টবিজয়ী হলেও খোদ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা এ দু'জনকে পুরোপুরি বাঙালি বলতে নারাজ। দু'জনের বাবা-মা বাঙালি হলেও ছোটবেলা থেকেই তারা বড় হয়েছেন বাংলার বাইরে_ পড়াশোনাও বাংলায় করেননি। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তাকিয়ে ছিল পরিপূর্ণ কোনো বাঙালি এভারেস্টবিজয়ী অভিযাত্রীর দিকে, যার শরীর ও জীবন পুষ্ট বাংলার মাটি, বাংলার পানি আর বাতাসে। আর তারাই হলেন বসন্ত কুমার সিংহ রায় ও দেবাশীষ বিশ্বাস।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের জেলা কৃষ্ণনগরের পর্বতারোহণ ক্লাবের নাম 'মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অব কৃষ্ণনগর'। অনেক কঠিন ও বিখ্যাত পর্বত জয়ের সঙ্গে এটি জড়িত। বাংলাদেশের সঙ্গে 'ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ রুবালকাং' অভিযানের সাফল্যের সুবাদে ক্লাবটি এ দেশেও পরিচিত। এই ক্লাবের দলনেতা বসন্ত সিংহ রায়। পেশায় ব্যাংকার। মা পান্না রানী রায়, স্ত্রী স্মিতি মণি রায় এবং ছেলে রোমিও অভ্যস্ত বসন্তের পর্বতারোহণের সঙ্গে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যশোরে জন্মগ্রহণকারী দেবাশীষ বিশ্বাস ভারতীয় আয়কর বিভাগের চাকুরে। ৩৯ বছর বয়স্ক দেবাশীষকে মা বিমলা দেবী, স্ত্রী মুক্তি বিশ্বাস আর দুই ছেলে শান্তনু ও দেবাংশু পর্বতারোহণে উৎসাহ দেন। পরিবারের সমর্থন, চাকরিগত কারণে মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি, স্পন্সরের সহযোগিতা আর বহুদিনের বহু কঠিন পর্বতারোহণ অভিজ্ঞতা তাদের সাফল্যের কারণ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া বিভাগ, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক আর কিছু সংস্থা ও ব্যক্তির আর্থিক সাহায্যে ৫০ লাখ ভারতীয় রুপীর এ অভিযানে সহায়ক ক্লাইম্বিং এজেন্সি ছিল লোবেন এক্সপিডিশন লিমিটেড। অভিযাত্রী দলটি ২ এপ্রিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পেঁৗছে। অতঃপর লুকলা হয়ে ট্রেকিং করে এভারেস্ট বেসক্যাম্প- তারপর মহাআরাধ্য এভারেস্টে অভিযান। গোরেকশেপে বেসক্যাম্প থেকে বিপজ্জনক খুম্বু আইসফল পার হয়ে ১৯ হাজার ৩৫২ ফুটে ক্যাম্প-১, ২০ হাজার ৬৬৪ ফুটে ক্যাম্প-২, ২৪ হাজার ২৭২ ফুটে ক্যাম্প-৩ এবং ২৫ হাজার ৯১২ ফুটে ক্যাম্প-৪ স্থাপন করেন।১৬ মে রোববার সন্ধ্যা ৮টা ৩০ মিনিটে ২৫ হাজার ৯১২ ফুট উঁচু সামিট ক্যাম্প থেকে চূড়া জয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন দলনেতা বসন্ত সিংহ রায়, দেবাশীষ বিশ্বাস এবং দুই শেরপা পাসাং ও পেম্বা। দীর্ঘ কষ্টকর আরোহণ শেষে ২০১০ সালের ১৭ মে সোমবার নেপাল সময় সকাল ৮টায় দুই নেপালি শেরপাসহ দুই বঙ্গবীর আরোহণ করেন মর্ত্যের শীর্ষবিন্দু, বাঙালির দীর্ঘ ছয় দশকের আরাধ্য এভারেস্টে। বেসামরিক বাঙালির পদচিহ্ন পড়ল এভারেস্টে।
অন্যদিকে বাঙালির নিজস্ব আবাসভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশিদের নিয়মিত পবর্তারোহণের পথে পদচারণা শুরু ২০০৩ সালে। এর আগে ১৯৬৯ সাল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন পর্বতারোহণ শুরু করলেও এভারেস্ট বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে শুরু হওয়া বাংলাদেশের নিয়মিত পর্বতারোহণ এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে ৪০ জনের কাছাকাছি সমাপ্ত করেছেন পদ্ধতিগত পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ। গঠিত হয়েছে 'বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং ও ট্রেকিং ক্লাব', 'কেউক্রাডং বাংলাদেশ', 'নর্থ আলপাইন ক্লাব, বাংলাদেশ' ও 'টিম এক্সটিম' নামে কয়েকটি ক্লাব।
বাংলাদেশের নিয়মিত পর্বতারোহণকারীদের মধ্যে মুসা ইব্রাহীম এবং এমএ মুহিত এ বছরই আলাদা আলাদাভাবে দুটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক এভারেস্ট অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এমএ মুহিত বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের হয়ে অনেক ব্যর্থ ও সফল অভিযান করে নিজেকে প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে তার ২৬ হাজার ৯০৬ ফুট উচ্চতার চৌ উ অভিযান উল্লেখযোগ্য। এ বছরের এপ্রিলে মুহিত মাউন্টেন ভিউ ও আকিজ গ্রুপের স্পন্সরে এভারেস্ট অভিযান শুরু করেন। বিখ্যাত শেরপা পেম্বা দর্জির ওয়ার্ল্ড সমিটারসের আয়োজনে তিব্বতের নর্থ রুট ধরে অভিযান শুরু করে ক্যাম্প-৩ পর্যন্ত পেঁৗছেন ১৯ মে। তারপর খারাপ আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে ঢাকা থেকে যাওয়া সিদ্ধান্তে বেসক্যাম্পে নেমে আসেন। এভাবেই শেষ হয় মুহিতের এবারের এভারেস্ট স্বপ্ন।
অন্যদিকে এভারেস্ট জয়ে আরেক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীম তার নর্থ আলপাইন ক্লাব থেকে প্রথমে অন্য অ্যাডভেঞ্চার করে গুছিয়ে পর্বতারোহণ শুরু করেন। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বরে ২১ হাজার ৮১ ফুট উচ্চতার লাংসি সারি ও ২০০৯-এর ১৪ মে ২৪ হাজার ৬৮২ ফুট উচ্চতার অন্নপূর্ণা অভিযানে সফল না হলেও এভারেস্ট জয়ের দৃঢ় সংকল্পে এ বছরের এপ্রিলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এভারেস্ট অভিযানে নামেন। ১০ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে সঙ্গী কৈলাশ তামাং, সোম বাহাদুর তামাং, লাকপা নুরু শেরপা, জিরেল লাল বাহাদুর প্রমুখসহ রওনা দিয়ে ১৩ এপ্রিল ১৭ হাজার ৫৬ ফুট উঁচু তিব্বতীয় এভারেস্ট বেসক্যাম্পে পেঁৗছান। ১৪ এপ্রিল বাংলা ও নেপালি নববর্ষে যাত্রা করে মধ্যবর্তী ক্যাম্প, ১৮ এপ্রিল অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প, ২৪ এপ্রিল ২৩ হাজার ২৮৮ ফুট উচ্চতার নর্থ কোলে পেঁৗছান। অতি উচ্চতায় খাপ খাইয়ে নিতে এই দেরি। খারাপ আবহাওয়ার জন্য ৩ মে নেমে আসেন বেসক্যাম্পে।
১৩ মে আবার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প। আবার ঝড়সহ খারাপ আবহাওয়া। প্রচণ্ড ঝড়ে তাঁবু উড়িয়ে গেছে, ভেঙে গেছে। তবু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন অন্য দলের, মুহিতের মতো নেমে গেলেন না। ফল পেলেন ধৈর্যের। ২১ মে আবহাওয়া ভালো হলে রওনা দিয়ে ক্যাম্প-২। ২২ মে দুপুর ২টায় ক্যাম্প-৩ বা সামিট ক্যাম্পে পেঁৗছলেন। ওইদিন রাত ৮টায় আকাশে জ্যোৎস্নার আলোয় সাদা বরফে হেড লাইটের টর্চের মিছিলে শুরু হলো চূড়ান্ত অভিযান। নানা দুর্গমতা অতিক্রম করে ১০ ঘণ্টা পর ভোরের সূর্য ওঠার কিছু পর পেঁৗছে গেলেন মর্ত্যের শীর্ষবিন্দু এভারেস্টে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে পেঁৗছে দিলেন সাফল্যের চূড়ায়।
No comments:
Post a Comment