বিশিষ্ট শিল্পপতি, আজাদ প্রোডাক্টস ও গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের মালিক আবুল কালাম আজাদের গ্রেপ্তার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা রহস্য। বৃহস্পতিবার রাতে পুরানা পল্টনের অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আজাদকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। গতকাল তাকে ১ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তার গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে পুলিশ একবার বলছে, পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সারোয়ার তার ভাইয়ের চাকরির জন্য পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে বেদম প্রহার করে রক্তাক্ত করা হয়। অন্যদিকে, বিবিসিকে মতিঝিল অঞ্চলের পুলিশের উপ-কমিশনার খন্দকার মুহিতউদ্দিন আরও বলেন, আজাদ জাল টাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তার রুমে ওই সময় দুজন কৃষ্ণাঙ্গও ছিল। ওদিকে পুলিশ কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়কে চাকরি এবং চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দেয়ার কারণেই আজাদ প্রোডাক্টসের মালিক আবুল কালাম আজাদকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার একমাত্র ছেলে জিয়াউর রহমান আজাদ। আজাদ আরও জানান, বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটায় ৫৫ পুরানা পল্টনের গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের ১২০৫ নম্বর কক্ষে প্রতিদিনকার মতো বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আজাদ প্রোডাক্টসের মালিক আবুল কালাম আজাদ। পূর্বানুমতি ছাড়াই ওই কক্ষে ঢোকেন সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তা গোলাম সারোয়ার। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করায় খানিকটা ক্ষুব্ধ হন আজাদ। নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি থানায় ফোন করার চেষ্টা করেন। এ সময় ওই পুলিশ সদস্য তার এক নিকটাত্মীয়কে চাকরি দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন এবং তাকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলেন। অপ্রস্তুত আজাদ তাকে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আবুল কালাম আজাদের একমাত্র ছেলে জিয়াউর রহমান আজাদ জানান, গোলাম সারোয়ার তার অনুরোধ না রেখে উত্তেজিত হয়ে তাকে হুমকি দিতে থাকেন। আবার এই বলে শাসান, যদি টাকা এবং চাকরি দেয়া না হয় তাহলে জাল ডলার মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। ওই সময় আজাদ তার হোটেলের কয়েকজন কর্মকর্তাকে তার কক্ষে ডাকেন। তাদের উপস্থিতিতে অন্যায়ভাবে একজন ব্যবসায়ীর কক্ষে ঢোকার অপরাধ স্বীকার করে সাদা কাগজে লিখিত দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান পুলিশের ওই কর্মকর্তা। গতকাল পরিবাগের বাসায় তিনি আরও বলেন, তার বাবার ওই কক্ষে তিনি ও তার দুই বোন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। তবে মাঝে মধ্যে অফিসের প্রয়োজনে ওই রুমে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ডেকে নিতেন তিনি। সাদা পোশাকে একজন পুলিশ অনুমতি ছাড়া তার বাবার কক্ষে ঢুকে অন্যায় করেও উল্টো তার বাবাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তার কথা, দেশের একজন সিআইপি ব্যক্তি হিসেবে তার বাবা কাউকে অফিসে ডেকে নিয়ে মারধর করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুধু বাবা হিসেবে বলেই তার এ দাবি নয় বলে জিয়া বলেন, তার বাবা বছরে লাখ লাখ টাকা সরকারকে রাজস্ব দেন। আর তাকে এভাবে হয়রানি করে পুলিশ বুঝিয়ে দিল তারা সব পারে। এদিকে থানা হাজতে থাকা আবুল কালাম আজাদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে গতকাল রাত সাড়ে আটটায় তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে, আজাদ প্রোডাক্টসের অর্থ ও হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তা ওই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, তাদের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই পুলিশ কিভাবে মালিকের কক্ষে ঢুকলেন_ এটাই তার কাছে বড় বিস্ময়। ওই সময় হোটেলের দোতলার অফিস রুমে তিনি কাজ করছিলেন। মালিকের ডাকে তিনিসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ১২০৫ নম্বর কক্ষে গিয়ে পুলিশ সদস্যকে দেখতে পান। এ সময় আজাদ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সারোয়ারের কাছ থেকে লিখিত চান। সাদা কাগজে লিখিতভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে সারোয়ার সেখান থেকে বের হয়ে আসেন বলে দাবি করেন তিনি। আবুল কালাম আজাদের ভায়রা আনিস বলেন, রাত সাড়ে নয়টায় বাসার উদ্দেশে অফিস থেকে বের হন আজাদ। এ সময় পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যায়। তার দাবি উনি (আজাদ) যদি কোন অন্যায় করতেন তাহলে হয়তো প্রকাশ্যে বাসায় ফিরতেন না। আর কাউকে পিটানোর মতো লোক নন তিনি। আর তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা হাস্যকর। কারণ কারও হাতঘড়ি কিংবা গলার সোনার চেইন চুরি করার মতো কাজ আজাদ করবেন- এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার কামনা করছেন আজাদের পরিবার। ওদিকে বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় গোলাম সারোয়ার বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গতকাল তাকে কোর্টে পাঠিয়ে পুলিশ পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করলে মহানগর হাকিম আবদুর রহিম এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাজহার হোসেন বলেন, আজাদকে গ্রেপ্তার করার সময় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জিনিস জব্দ করা হয়েছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার গন্ধ পাচ্ছেন তারা। আশা করছি, অনেক কিছুই বের করতে পারবো। মামলার বাদী গোলাম সারোয়ার জানান, ১৯৯১ সাল থেকে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে তার পরিচয়। সমপ্রতি আজাদ প্রোডাক্টসের ডিজাইনার পদে তার ভাই নাসির উদ্দিনের চাকরির জন্য আজাদের দ্বারস্থ হন তিনি। নাসিরকে চাকরি দেয়ার কথাও দেন আজাদ। সে অনুসারে গত বৃহস্পতিবার জীবন-বৃত্তান্তসহ নাসিরকে নিয়ে আসার জন্য বলেন তিনি। সারোয়ার জানান, চার-পাঁচদিন আগে আজাদ তাকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দেন। ভাইয়ের চাকরির ব্যাপারে মোবাইল ফোনে কয়েকবার আজাদের সঙ্গে কথাও হয় তার। এদিকে পুলিশ জানায়, সর্বশেষ পাঁচ দিন আগে মোবাইল ফোনে আজাদের সঙ্গে কথা হয় গোলাম সারোয়ারের। সে জন্য গত বৃহস্পতিবার নাসিরকে নিয়ে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে যান গোলাম সারোয়ার। ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে অপেক্ষা করেও আজাদের দেখা পাননি। ফোনও ধরছিলেন না তিনি। পরে স্টাফদের কথা অনুযায়ী হোটেলের ১২তলায় চলে যান সারোয়ার। ১২০৫নং রুমে কলিং বেল টিপার চার পাঁচ মিনিট পর বের হয়ে আসেন আজাদ। সঙ্গে সঙ্গে শার্টের কলার ধরে সারোয়ারসহ তার ভাইকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে যান। এ সময় স্ক্যানার মেশিনসহ দুজন আফ্রিকান লোকও ছিল ১২০৫ নম্বর রুমে। বিছানার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ডলার। কোন কথা না বলেই আজাদ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১২টা থেকে তিনটা পর্যন্ত পুরো তিন ঘণ্টা ধরে তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান গোলাম সারোয়ার। পরে বিকাল তিনটায় পল্টন থানা পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। সারোয়ারের বক্তব্য, সারা শরীর তার রক্তে ভেসে যায়। যদিও গতকাল তাকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখা গেছে। উদ্ধারকৃত মালামাল: আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ ১২০৫নং কক্ষ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মালামাল উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত মালামালগুলো হচ্ছে একটি কম্পিউটারের সিপিইউ, ২২টি সিডিসহ একটি বক্স, রাজউকের একটি অনুমোদনকারী সিল, একটি ভবনের নকশা, একটি অডিও ক্যাসেট, গোলাম সারোয়ারের ভাঙা চশমা। এসআই মাজহার বলেন, রাজউকের সিল কেন তার কাছে থাকবে? আবার একটি ভবনের নকশাও ছিল তার কাছে। সবকিছুই সন্দেহজনক। তবে তদন্ত ছাড়া আর কিছু বলতে চাই না আমি। আইনজীবীর বক্তব্য: আবুল কালাম আজাদের আইনজীবী নজীবুল্লাহ হিরু বলেন, কোন অনুমতি ছাড়াই জোরপূর্বক তার ব্যক্তিগত রুমে ঢুকে পড়েন সিআইডি অফিসার গোলাম সারোয়ার। কোন সময়ই অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত রুমে কারও ঢোকা পছন্দ করেন না আবুল কালাম আজাদ। এ সময় গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। গোলাম সারোয়ার আজাদকে পুলিশি ভয়ভীতি দেখান। এ সময় তিক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে। পরে অন্য পুলিশ অফিসারের উপস্থিতিতে লিখিত মুচলেকা দেন গোলাম সারোয়ার। এ জন্য ক্ষমাও চান তিনি। অন্যদিকে, গতকাল আদালতে হাজির করা হয় আবুল কালাম আজাদকে। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে পাঁচদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হলে মহানগর হাকিম মো. আবদুর রহিম একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গোলাম সারোয়ার মুচলেকায় যা লিখেছেন: 'আমি গোলাম সারওয়ার, পিতা আবদুল হাকিম তালুকদার, সাং ডেমরা, থানা- ডেমরা, জেলা- ঢাকা অদ্য ২৭-০৮-২০০৯ তারিখ আজাদ প্রোডাক্টস এর মালিক মি. আবুল কালাম আজাদের সাথে বিনা অনুমতিতে তার শয়ন কক্ষে ঢোকার জন্য কলিং বেল দিয়ে যে অন্যায় করেছি তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। সারওয়ার- ২৭-০৮-০৯'
August 29, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment