July 26, 2009

টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, কেবিনেট কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষা

পরিতোষ পাল, কলকাতা থেকে: টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির ব্যাপারে প্রথম থেকেই ভারত সরকার গোপনীয়তা নিয়ে চলেছে। বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে বারবার সরকারি স্তরেই আপত্তি উঠেছে। পরিবেশ দপ্তরের অনাপত্তিপত্র বা ছাড়পত্র পেতে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটি প্রথম দফায় আবেদনপত্র ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে। পরে অবশ্য তারা পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা যে সেই ১৯৭১ সাল থেকে চলছে তা ভারতের হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী নিজেই ঢাকায় এক সেমিনারে জানিয়েছেন। তবে প্রথম দিকে আসামের কাছাড় এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে এটিকে বহুমুখী জলবিদু্যৎ উৎপাদন প্রকল্পে রূপান্তরিত করা হয়। বলা হয়, ১৫০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করা হবে। আর এই বিদু্যৎ আসামকে যেমন আলোকিত করবে তেমনি বাংলাদেশকেও দেয়া হবে। তবে সরকারি সূত্রেই জানানো হয়েছে, ১৫০০ মেগাওয়াটের কথা বলা হলেও আসলে তৈরি হবে মাত্র ৪২৫ মেগাওয়াট বিদু্যৎ। কিন্তু এই প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি কখনওই। অথচ এই তথ্য জানার দাবি জানানো হয়েছে বহুবার। এমনকি যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে এই প্রকল্প তৈরি করা হবে তার ভায়েবিলিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন। অবশ্য এই প্রকল্প তৈরির ব্যাপারে অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম থেকেই। ভারত সরকার এই প্রকল্প তৈরির দায়িত্ব দেয় সরকারি সংস্থা নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড বা নিপকো-কে। তবে মণিপুরের মানুষের প্রতিবাদের মুখে সরকার খানিকটা থমকে যায়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার আবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের আমলে সরকার প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০০১ সালে মণিপুর সরকারের সঙ্গে নিপকো এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে মণিপুর সরকারকে এর সঙ্গে জুড়ে নেয়। তবে তখন মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন চলতে থাকায় পরবর্তীকালে অর্থাৎ ২০০৩ সালের নির্বাচিত মণিপুর সরকার সেই স্মারক অনুমোদন করে। আর তারপর থেকেই বাঁধ তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয় দ্রুত তালে। সমস্ত জনমত উপেক্ষা করে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করে। ওই বছরেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-র এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা থাকলেও তা রহস্যজনক কারণে বাতিল হয়ে যায়। আর তারপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই একরকম চুপিসারে ২০০৬ সালের ২রা ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন বিদু্যৎমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্ধে ভারি শিল্পমন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবকে সঙ্গী করে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এমনকি টিপাইমুখে ড্রিলিং ও অন্যান্য কাজও শুরু করে দেয়া হয়েছিল কড়া নিরাপত্তায়। কিন্তু আন্দোলনকারী স্থানীয় জনগণ প্রকল্প এলাকায় ঢুকে সব যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করার ফলে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ ভারত সরকার এই পর্যায়েও বাংলাদেশ সরকারকে প্রকল্পের ব্যাপারে কোনভাবে অবহিত করেনি বলে জানা গেছে। কিন্তু ২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী ও যৌথ নদী কমিশনের যৌথ চেয়ারপারসন প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সী পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে কোন নদী প্রকল্পের কাজে ভারত হাত দেবে না। কিন্তু মন্ত্রীর সেই আশ্বাস রক্ষা করা হয়নি বলে অভিযোগ। তবে প্রকল্প নিয়ে ২০০৫ সালের নভেম্ব্বরে যেসব প্রশ্ন তুলে এক্সপার্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটি নিপকো'র আবেদন ফেরত পাঠিয়েছিল সেগুলো ছিল গুরুতর। অ্যাকশন কমিটি এগেনস্ট টিপাইমুখ ড্যাম-এর জনৈক মুখপাত্র জানান, কোন রকম পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা বা পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করেই বাঁধ তৈরির জন্য ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছিল। তিনি আরও জানান, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতেও ফের আবেদন ফেরত পাঠানো হয় নানা অসম্পূর্ণতার জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর অফিসের চাপেই নাকি কিছুদিন আগে সেই ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী নেতারা। মণিপুরের পরিবেশ দপ্তরও দ্বিধা কাটিয়ে ছাড়পত্র দিয়েছে সমপ্রতি। এখন গোটা প্রকল্পটি পাঠানো হয়েছে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়ক কেবিনেট কমিটির কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। আর সেই অনুমোদন পেলেই পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে বাঁধ তৈরির। ৮৭ মাসের মধ্যেই তৈরি করা হবে এই প্রকল্প। তবে দিলি্লর একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার আগে সরকার বিষয়টি কেবিনেট কমিটিতে আলোচনায় রাখতে চাইছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে টিপাইমুখ ইসু্যতে যাতে কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ না করে সেজন্য ভারত সরকার সতর্কভাবে এগোতে চাইছে। আর তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সমপ্রতি শেখ হাসিনাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor