অভাবনীয় ও ঐতিহাসিক জয়। প্রথমে টেস্ট, পরে সিরিজ। বিদেশের মাটিতে একই সফরে দু'টি জয়ের ষোলকলা পূর্ণ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সোমবার রাতে গ্রেনাডায় সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ৪ উইকেটে পরাস্ত করে এক সময়ের বিশ্বসেরা ক্রিকেট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জয়ই নয় কেবল, কোন দেশের বিরুদ্ধে পর পর দু'টেস্টে জয়ের কৃতিত্বও এই প্রথম। ২০০০ সালে টেস্ট পরিবারের সদস্য হওয়ার পর থেকেই সংগ্রামের শুরু। কুলীন শ্রেণীর দলগুলোর কাছে একের পর এক সিরিজ পরাজয়ে বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস। অনেক দেশ এখন আর বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। ব্যর্থতার ধারা অব্যাহত থাকায় বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থা আইসিসিও ভাবছে দু'টি ভাগে বিভক্ত করে বাংলাদেশের টেস্ট পরিধি ছোট করে দেয়ার কথা। এমনি সময় এলো কাঙ্ক্ষিত সেই জয়। না, বিচ্ছিন্ন একটি ম্যাচ জয় নয়। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইতিহাসের প্রথমটা পাওয়ার পর বিজয়ের অনুভূতি ভুলতেই বসেছিল বাংলাদেশ। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর সেই অনুভূতির দেখা মেলে গত সপ্তাহে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সেই ম্যাচে ৯৫ রানে হারিয়ে আক্ষেপ দূর করে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে যা আসে দ্বিতীয়বারের মতো। আর বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো বিজয়ী বেশে বাংলাদেশ। সেই জয়ের পর থেকেই দম বন্ধ করে অপেক্ষার শুরু। ইতিহাসে দ্বিতীয় সিরিজটা জিততে পারবে তো বাংলাদেশ? একরাশ শঙ্কা নিয়ে গ্রেনাডায় খেলতে নামে বাংলাদেশ- দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার অধিনায়ক মাশরাফীকে ছাড়াই।
নেতৃত্বের অভিজ্ঞতাহীন সাকিব আল হাসানের কাঁধে ভর করে শুরু হয় লড়াই। প্রথম টেস্ট জিতে থাকায় অনেকেই আশায় ছিলেন গ্রেনাডা টেস্ট অন্ততপক্ষে ড্র করুক বাংলাদেশ। ক্রিকেট যারা বোঝেন না, কিংবা কালেভদ্রেও যারা ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন না তারাও হাজার মাইল দূরে খেলতে নামা বাংলাদেশ দলের জন্য প্রার্থনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত সব অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। না, অতীতের মতো কোন আক্ষেপ দিয়ে নয়। কাঙ্ক্ষিত সিরিজটা জিতেছে বাংলাদেশই। ড্র করে নয়, বীরের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪ উইকেটে হারিয়ে। যার ওপর হঠাৎ করেই এসে পড়েছিল দলের দায়িত্ব সেই সাকিব আল হাসান বলতে গেলে একাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি এনে দিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে দু'দলের ব্যবধান মাত্র ৫ রান হওয়ায় এক ইনিংসে পরিণত হওয়া ম্যাচে প্রথমে বল হাতে ৫ উইকেট শিকারের পর ব্যাট হাতে খেলেন ৯৭ বলে ৯৬ রানের ম্যাচ জয়ী ইনিংস। তার ইতিহাস গড়া ওই পারফরমেন্স ম্লান করে দেয় ড্যারেন সামির রুদ্রমূর্তি হয়ে ওঠাকে। একাই ৫ উইকেট নিয়ে রীতিমতো ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সামি। কিন্তু সাকিবের কাছে অন্যদের মতো সামিও ম্লান হয়েছেন। এ কারণে দলের এই জয়কে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিটা দিয়েছেন খোদ সাকিবই।
'টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার নয় বছরে এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জন।' ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে কথা বলতে গিয়ে এভাবেই নিজের আবেগ প্রকাশ করেন সাকিব। নিজেকে সামলে নিয়েই বলেন, 'এ বিজয় আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যা আমাদের পরের ধাপে এগিয়ে যেতে সহায়তা দেবে। অবশ্যই ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্রষ্টাকে। তার কৃপায় আমরা এখন আরও এগিয়ে যেতে চাই।' প্রথম ইনিংসে ৫ রানে এগিয়ে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২০৯ রানে গুঁড়িয়ে দিতে সাকিবেরই ছিল সবচেয়ে বড় অবদান। ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো ৫ উইকেট শিকার করে দলকে জয়ের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ব্যাটিং অর্ডারে নিজের অবস্থান যেহেতু ৬ নম্বরে সেহেতু দলের জয়ের বাকি আনুষ্ঠানিকতার দায়টা খুব বেশি হয়তো অনুভব করেননি দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগে। কিন্তু মাত্র ৬৭ রানে উপর সারির ৪ ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফিরে যাওয়ায় স্বভাবতই হারের শঙ্কা জেগে উঠেছিল সবার মনে। কিন্তু মাঠে নেমেই সাকিব পেয়ে যান সহযোদ্ধা রকিবুল হাসানকে। দু'জনে মিলে দেখিয়েছেন কিভাবে খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তুলতে হয়। আর ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ১০৬ রানের জুটি গড়ে রকিবুল (৬৫) বিদায় নেয়ার পর সাকিব দেখিয়েছেন কিভাবে সব শঙ্কা দূর করে দলকে জেতাতে হয়। জয় থেকে দলকে ৪২ রান দূরে রেখে যখন ফিরে গেলেন রকিবুল তখন আবারও তীরে এসে তরী ডোবার ভয় পেয়ে বসে সবার মনে। জয় থেকে ১৪ রান দূরে থাকতে মুশফিক সাজঘরে ফিরে ভয়টা আরও বাড়িয়ে দেন। কিন্তু উইকেটে ছিলেন সাকিব। যে কেমার রোচের ভয়ে রীতিমতো কম্পমান ছিল বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা সেই রোচের এক ওভারে দু'টি চার ও ১টি ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে পাইয়ে দেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়। ম্যাচ জয়ের পর জোর গলায়ই বলেন কোন রকম চাপ অনুভূত হয়নি তার। বলেন, 'আমরা কখনওই খুব বেশি চাপ অনুভব করিনি। বিশেষ করে আমার নিজের মধ্যে কোন চাপ ছিল না। নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলবো বলেই নেমেছিলাম। দলের সবাই দারুণ ক্রিকেট খেলেছে বলেই এমন একটা জয় এসেছে।'
প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের অভিনন্দন
বিদেশের মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া পৃথক পৃথকভাবে জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেট, জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল এমপিও অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক জয়ের জন্য ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়, অধিনায়ক, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট এবং ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফি জয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নবযাত্রার সূচনা হয়। পরবতর্ীতে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নিয়ে সম্মানজনক ফলাফল নিয়ে আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা অর্জন করে। দীর্ঘদিন পর বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় আমাদের ক্রিকেটকে আরও মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে। তিনি এ জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানান। স্পিকার আবদুল হামিদ তার অভিনন্দন বার্তায় বলেন, এ অবিস্মরণীয় জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ক্রিকেট বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করবে আশা প্রকাশ করে খেলোয়াড় ও বোর্ডের প্রতি এ জয়ের ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বিজয়ের পেছনে অনন্য নৈপুণ্যের জন্য ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক সাকিবকে ধন্যবাদ জানান।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার পুরস্কার হিসেবে ক্রিকেটার এবং টিম ম্যানেজমেন্টকে দেড় কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করেছে। কোন সিরিজ জিতলে বিসিবি'র পক্ষ থেকে উইনিং বোনাস দেয়ার চল আগে থেকেই ছিল। তবে এবার বোনাসের পরিমাণ ক্রিকেটাররা বেশি পাচ্ছে জয়ের ব্যবধানটা ২-০ হওয়ায়। হোয়াইটওয়াশ করতে পারলে বিসিবি'র হিসাব অনুযায়ী ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বোনাস দেয়ার কথা থাকলেও দলকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আরও ২০ লাখ টাকা বাড়তি দেয়া হবে। গতকাল বিসিবি'র সভাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনা ইবনে জামালি দলকে অভিনন্দন জানিয়ে ওই বোনাস দেয়ার ঘোষণা দেন। বোনাসের অর্থ সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে টেস্ট দলের ২৩ সদস্যের মধ্যে। বিসিবি সভাপতি বলেন, 'আমি ক্রিকেটারদের পাশাপাশি টিম ম্যানেজমেন্ট ও ক্রিকেট অপারেশন্স ডিপার্টমেন্টের সকল কর্মকর্তাকে অভিনন্দন জানাই। এ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ দল তাদের এবং লাখো ক্রিকেটপ্রেমীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারলো। ওদিকে বাংলাদেশ দলের এমন সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। তিনি বলেন, 'এ জয় কেবল জাতীয় ক্রিকেট দলের জয় নয়। এ জয় বাংলাদেশের চৌদ্দ কোটি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের জয়।' তিনি আজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বিদেশের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয় নিয়ে একটি উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন (বিওএ), ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), হকি ফেডারেশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
No comments:
Post a Comment