অবশেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়েছেন আবদুল জলিল। টানা এক বছরের বেশি সময় কাগুজে সাধারণ সম্পাদক থাকার পর গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে ওই পদ ত্যাগের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, সম্মানজনক প্রস্থানের সুযোগ পাই নি বলেই পদত্যাগ করলাম। এতে কষ্ট থাকলেও আক্ষেপ নেই। আর এছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। পদ ছাড়লেও আওয়ামী লীগেই থাকবো। আবদুল জলিলের গুলশানের বাসায় ওই সংবাদ সম্মেলনের পর তার পক্ষে নওগাঁ জেলার কয়েকজন এমপি দলের সভানেত্রীর কার্যালয়ে এ পদত্যাগপত্র পেঁৗছে দেন। আবদুল জলিলের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতাও প্রকাশ করেন তারা। দলের জাতীয় কাউন্সিলের মাত্র দু'দিন আগে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আবদুল জলিল বলেন, দলের কাউন্সিলে অংশ নিতে না পারার বেদনা থেকেই তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের এক পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান তিনি। তবে কোন প্রশ্নের জবাব দেননি। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রত্যাশা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রি বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবো। যখন দেখলাম, আমার শেষ সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত হলাম তখন আমার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। তাই আমি আজ (গতকাল) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করছি। তিনি বলেন, আমি যতদিন বাঁচবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন কর্মী হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলই করে যাবো। তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক সাধারণ সম্পাদক দলের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। সে মোতাবেক দাওয়াত পত্র তার নামেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণ সম্পাদকই কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করবে। সে সুযোগ থেকেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আবদুল জলিল বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার হয় না। ১/১১-এর কারণে দলের কাউন্সিল হতে সময় লেগেছে। আমি আগেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলেছি। ছয় মাস আগেও এ কথা বলেছি। পদত্যাগের পর দলের কাউন্সিল ও কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে যাবেন কিনা সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখনও কাউন্সিলর আছি। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখবো। সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার সময় তার বাসায় নওগাঁ জেলার পাঁচ এমপি এমাজউদ্দিন প্রামাণিক, ইসরাফিল আলম, সাধন কুমার মজুমদার, শহিদুজ্জামান সরকার, শাহীন মনোয়ারা হকসহ জেলা আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। আবদুল জলিলের এ ঘোষণার পর তাদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে দলের ১৯তম কাউন্সিলে আবদুল জলিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালের ২৮শে মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাবন্দি অবস্থায় একটি চিঠিতে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়ার ঘোষণা দিলেও জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি ফের পদে ফেরার ঘোষণা দেন। এ নিয়ে দলে জটিলতা দেখা দেয়। সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকলেও তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। সে সময় থেকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০৮ সালের ২রা মার্চ চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পান আবদুল জলিল। সিঙ্গাপুরে ছয় মাস চিকিৎসা নেয়ার পর গত বছরের ৩১শে আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ২০শে অক্টোবর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি হাসপাতাল হতে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছিলেন। তার নিজের স্বাক্ষর করা ওই চিঠি গত বছরের ৫ই জুলাই তার স্ত্রী রেহানা জলিল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তখন ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগে গণতন্ত্রের চর্চা নেই এবং এর জন্য সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও দায়ী করেছিলেন তিনি। চিঠিতে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল হয়েও এটি এখন একনায়ককেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। সভানেত্রীর একক নেতৃত্বে দল চলার কারণে এ অবস্থা এবং বিপর্যয় হয়েছে। ওই চিঠির সূত্র ধরেই আবদুল জলিলের সাধারণ সম্পাদকের পদ ঝুলে যায়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হয়। দেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জলিলের যে চিঠি তার স্ত্রী রেহানা জলিল প্রকাশ করেছিলেন তাতে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার জন্য তিনি তার অসুস্থতা এবং পারিবারিক কারণ উল্লেখ করেছিলেন। তবে মামলায় জামিন পাওয়ার পর তিনি দাবি করেন, বাধ্য হয়েই তিনি ওই চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠির বক্তব্য অস্বীকার করে আবদুল জলিল তখন বলেছিলেন, কারাবন্দি অবস্থায় কি চিঠি কোথায় কিভাবে এসেছে তা আপনারা সবাই বোঝেন। তিনি বলেন, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে তার স্ত্রী সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার মতো কোন চিঠি তিনি পড়েননি। কারামুক্ত হওয়ার পর দলের বৈধ সাধারণ সম্পাদক দাবি করে আবদুল জলিল বেশ কয়েকবার তাকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। সম্প্রতি তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন, উপদেষ্টারা গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নেন নি। তাদের মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকারও সাংবিধানিক বৈধতা নেই। সমপ্রতি দলের জাতীয় কাউন্সিল প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও তিনি বেশ কয়েকবার এ প্রক্রিয়ায় তাকে যুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমে খোলামেলা কথাও বলেন। সর্বশেষ গত ১৭ই জুলাই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজেদা চৌধুরী সাংবাদিকদের এ বিষয়ে জানান, অসুস্থতার কারণে আবদুল জলিলকে দলের কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটিতে রাখা হয়নি।
আবদুল জলিল ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৭ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬০-৬১ সালে ঢাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালে ডাকসু'র কমন রুম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের মার্চে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন চলে যান। ১৯৬৯ সালে দেশে ফিরে গণআন্দোলন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর একবার এবং ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের সময় কারাবরণ করেন। ১৯৮১ সালে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালেও একই আসন থেকে তিনি এমপি হন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত নির্বাচনেও তিনি নওগাঁ থেকে সংসদ সদস্য হন।
No comments:
Post a Comment