প্রথম টেস্ট জয়ে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় ৫ বছর। ২০০৫-এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রথম জয়টি পায় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে। তার সাড়ে ৪ বছর পর এলো দ্বিতীয় জয়টি। তবে ৬০ টেস্টে দেশের বাইরে এটিই বাংলাদেশ দলের প্রথম জয়। তবে প্রথমবারের মতো দলকে নেতৃত্বে দিতে এসেই মাশরাফী পেলেন চূড়ান্ত সাফল্য। অবশ্য ইতিহাস গড়া জয়ের কৃতিত্বের সিকি ভাগও দাবি করেননি নয়া অধিনায়ক। ম্যাচের তৃতীয় দিন সকালে হাঁটুর ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে মাঠ ছাড়ার পর আদতে নামেই অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফী। গত পরশু কিছুক্ষণের জন্য ব্যাট হাতে নেমেছিলেন মাঠে। কোন রান না করেই বিদায় নিয়েছেন তিনি। প্রায় তিন দিন মাশরাফীর অনুপস্থিতিতে দলের দায়িত্ব পালন করেছেন অধিনায়কত্বের কোনরকম অভিজ্ঞতা ছাড়া সাকিব আল হাসান। আর প্রথম পরীক্ষায় লেটার মার্কসসহ পাস করেছেন সাকিবও। অন্তত মাশরাফীর চোখে বাংলাদেশের জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান সাকিবেরই। নিজের অনুপস্থিতিতে যেভাবে দলকে পরিচালনা করেছেন সাকিব_ তা দেখে অভিভূত মাশরাফী নিজেও। যে কারণে ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বারবারই সাকিবকে জানালেন 'স্পেশাল থ্যাঙ্কস'। সে সঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই ৮ (প্রথম ইনিংসে ৩/৫৯ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫/৫১) উইকেট নেয়া অফ স্পিনার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এবং প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলকে লড়াইয়ের পুঁজি দেয়া তামিম ইকবালকে। তাদের কৃতিত্বেই যে ২৭৭ রানের টার্গেট দিয়ে বাংলাদেশ জিতেছে ৯৫ রানে।
দেশত্যাগের আগে ডেপুটি সাকিবের ওপর অগাধ আস্থার কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন মাশরাফী। তবে সকলের মতো নিজেও ভাবেননি অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম ম্যাচেই সাকিবের ওপর নির্ভর করতে হবে তাকে। কিন্তু তা-ই হয়েছে। দলকে ঐতিহাসিক জয় পাইয়ে দেয়ার জন্য সাকিবকে ধন্যবাদ দিয়ে মাশরাফী বলেন, 'আমার অনুপস্থিতিতে দলকে যেভাবে ও পরিচালনা করেছে তার জন্য ওকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। এমন একটা জয়ের পর ইনজুরির হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে আমার।' ম্যাচ জয়ের দুই নায়ক রিয়াদ এবং তামিম সম্পর্কে মাশরাফী বলেন, 'ওদের দু'জনকে কেবল ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করা যাবে না। ওরা যা করেছে তার ফলাফলই হচ্ছে এই জয়।' পঞ্চম দিনে দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মাশরাফী বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য ছিল মধ্যাহ্ন বিরতি পর্যন্ত ব্যাটিং করে ৩০০ অথবা তারচেয়েও বেশি টার্গেট ওদের দিকে ছুড়ে দেয়া। কিন্তু দ্রুত ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলি আমরা। তারপরও আত্মবিশ্বাস ছিল দলে দু'জন নির্ভরযোগ্য স্পিনার থাকায়। সাকিব ও রিয়াদ দুর্দান্ত বোলিং করেছে। ওদের কৃতিত্ব দিচ্ছি এ কারণেই যে আমার ইনজুরির কারণে দল একজন বোলার কম নিয়ে খেলেছে। তারপরও আমরা জিতেছি।'
২৫২ রানের লিড নিয়ে চতুর্থ দিনে মাঠ ছেড়েছিল ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ। আগের দিনের ৩২১ রানের সঙ্গে আর ২৪ রান যোগ করতেই শেষ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। মাত্র চার রান তুলতেই বাংলাদেশ হারিয়েছে শেষ ৪ উইকেট। ৩৪৫ রানে গুটিয়ে যাওয়ায় স্বাগতিকদের জন্য ২৭৭ রানের টার্গেট ছুড়ে দিতে পারে বাংলাদেশ। ৮০ ওভারে ওই লক্ষ্য ছোঁয়া যে অসম্ভব তা বলা যাবে না। উপরন্তু প্রতিপক্ষ দলের মূল বোলারই যেখানে ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে মাঠের বাইরে সেখানে কাজটা আরও সহজ। কিন্তু সেন্ট ভিনসেন্টের ব্যাটিং সহায়ক উইকেট পঞ্চম দিনে যে স্পিনসহায়ক হয়ে উঠবে তা কে-ই বা ভেবেছিল। তৃতীয় ওভারেই সরাসরি থ্রোতে রিচার্ডসকে রানআউট করে শুরুটা করেছিলেন রকিবুল হাসান। এরপর ষষ্ঠ ওভারে প্রথম ইনিংসের নায়ক ফিলিপসকে এলবিডবি্লউ'র ফাঁদে ফেলেন সাকিব। ৩৩ রানে ২ ওপেনারকে হারিয়ে স্বভাবতই খোলসে ঢুকে পড়েন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা। যে কারণে বাংলাদেশকে তৃতীয় সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১ ঘণ্টা। কাপ্তান রেইফার (১৯)কে দিয়ে শুরু হয় রিয়াদের ধ্বংসযজ্ঞ। পরের ওভারেই তিনি পথ ধরান ডাউলিনকে। এর চার ওভার বাদে রিয়াদের শিকার সংখ্যা ৩ হয় ওয়ালটন (১০)কে এলবিডবি্লউ করে। তার বিদায়ের পর বেশ খানিকক্ষণের বিরতি। স্বাগতিকদের ড্রয়ের আশা জাগিয়ে রাখা বার্নার্ডের সঙ্গে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিলেন সামি। কিন্তু ৪২ বলে ১৯ রান করে তাকেও হার মানতে হয় সাকিবের কাছে। চা বিরতির আগে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে স্বভাবতই উজ্জীবিত মনে হয়েছে বাংলাদেশকে। শেষ সেশনে তাদের প্রয়োজন আর ৪টি উইকেট। কিন্তু ওই চার উইকেট নিতেই কম লড়াই করতে হয়নি বাংলাদেশের স্পিনারদের। একদিকে দেয়াল হয়ে ছিলেন বার্নার্ড। অন্যদিকে মিলারের উইকেট অাঁকড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা। মাত্র ৫ রান করলেও ৫৪ বল খরচ করে বার্নার্ডকে ভালই সহায়তা দেন মিলার। জুটিটা যখন জমে উঠছিল তখনই সাকিব বল তুলে দেন অভিজ্ঞ আশরাফুলের হাতে। ব্রেক থ্রু দিতে সিদ্ধহস্ত আশরাফুল এবার দলকে উৎসবে মাতালেন মিলারকে বিদায় করে। এরপর ২৪ বল খেলে রানের খাতা না খোলা অস্টিনকে এলবিডবি্লউ করে প্রথম ইনিংসের সাফল্যকেও ছাড়িয়ে যান রিয়াদ। পরের ওভারেই রোচকে মুশফিকের গ্লাভসবন্দি। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টেই ৫ উইকেটের কৃতিত্ব গড়েন রিয়াদ। তারপরও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়েনি বাংলাদেশের। একপ্রান্তে বার্নার্ড অবিচল ফিফটি হাঁকানোর পাশাপাশি ম্যাচটা ড্র করার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু দলকে জয়ের বন্দরে পেঁৗছে দেন সাকিব। শেষ ব্যাটসম্যান টিনো বেস্টকে ফুলটস বলে এলবিডবি্লউ করে বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদটা এনে দেন সাকিব। উইন্ডিজের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৮১ রানে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ২৩৮ এবং ৩৪৫/১০, ১২০.১ ওভার (তামিম ১২৮, জুনায়েদ ৭৮, মুশফিক ৩৭, সাকিব ৩০, ইমরুল ২৪, রকিবুল ১৮, রিয়াদ ৮, আশরাফুল ৩, রুবেল ১, মাশরাফী ০, শাহাদাত ০, সামি ৫/৭০, রোচ ৩/৬৭)। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০৭ এবং ১৮১/১০, ৭০.১ ওভার (বার্নার্ড ৫২, সামি ১৯, ডাউলিন ১৯, রেইফার ১৯, রিচার্ডস ১৪, ফিলিপস ১৪, ওয়ালটন ১০, রিয়াদ ৫/৫১, সাকিব ৩/৩৯, আশরাফুল ১/৪)। ফল: বাংলাদেশ ৯৫ রানে জয়ী। সিরিজ: ২ ম্যাচ টেস্ট সিরিজ বাংলাদেশ ১-০ তে এগিয়ে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ: তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।
No comments:
Post a Comment