প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও তিন বছরের জন্য বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে কমপ্রোমাইজ (সমঝোতা) বলে স্বীকার করে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, পলিটিক্স ইজ দ্য হাইয়েস্ট আর্ট অব কমপ্রোমাইজ। রাজনীতি হচ্ছে সমঝোতার সর্বোচ্চ শিল্প। আমি নৈতিকভাবে কালো টাকা সাদা করাকে সমর্থন করি না। তবে ধারাবাহিকতাকে মেনে নিতেই হবে। তাছাড়া অভিজ্ঞতাকে আপনি এড়াতে পারবেন না। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী সোজা-সাপটা ভাষায় বাজেট ফাঁস নিয়ে অভিযোগের দায়ও নিজের কাঁধে নিয়েছেন। তবে বলেছেন, কাউকে সুবিধা দেয়ার জন্য কিছু করিনি। বৃহস্পতিবার সংসদে বাজেট বক্তৃতার পর গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের পরিষদের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বেশ ক'জন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের পাশে নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবারও স্বীকার করে নেন, বাজেট প্রণয়নের চেয়ে বর্তমান সরকারের কাছে এর বাস্তবায়নই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট বক্তৃতায় বেশ কিছু লিখিত প্রমাদের কথাও সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে স্বীকার করে নেন তিনি। বর্তমান বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলে সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, উচ্চাভিলাষী বলেই বাস্তবায়ন ভাল হতে পারে। তিনি গত অর্থবছরের বাজেটের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই বাজেট উচ্চাভিলাষী ছিল বলেই আমরা তা থেকে অনেক ভাল ফসল পেয়েছি। বাজেট পেশের পর প্রথামাফিক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘাটতি জিডিপি'র পাঁচ ভাগ হওয়াকে বড় কিছু নয় বলেও দাবি করেন। তিনি বলেন, গত দশকে প্রতি বাজেটে ঘাটতি ছিল ছয় ভাগ। প্রতিবেশী দেশে এটি সাত ভাগ। পাকিস্তানে এ ঘাটতি ১০/১৫ ভাগ। তিনি বর্তমান বাজেটকে কৃষিবান্ধব উল্লেখ করে বলেন, বরাদ্দের হিসাবে এটি খুব বেশি বাড়েনি। তবে খাদ্য পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় এটির আকার বেড়েছে। মঞ্চে উপস্থিত কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও তার এ কথা সমর্থন করেন। বাজেট বাসত্দবায়ন নিয়ে ব্যর্থতার জবাবদিহি নিয়ে সীমাবদ্ধতার কথাও স্বীকার করে নেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ নিয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন করার পরামর্শ বিবেচনার দাবি রাখে বলেও জানান। অর্থনৈতিক জবাবদিহি সংসদে নতুন একটি আইনের প্রস্তাব বিবেচনাধীন আছে বলেও জানান। তবে ওই আইন নিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন কতখানি নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়ে তার সংশয়ের কথাও লুকাননি তিনি। বাস্তবায়নটা আমাদের বড় সমস্যা স্বীকার করেই তিনি বলেন, আমাদের টার্গেট পুরো বাস্তবায়ন। তবে ৯০ ভাগের বেশি বাস্তবায়ন করবোই। আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ মাথায় রাখতে পারি। তিনি বলেন, আহরণ করা কঠিন নয়। ব্যয় বাস্তবায়ন করাই কঠিন। শুধু রাজস্ব ব্যয় নয়, সব ধরনের ব্যয়। তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা দরকার। রাজনীতিবিদ, সংসদ, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন সবাইকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের সম্পৃক্ততা। তিনি উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যয় নিয়ে পাঁচটি উপায়ের কথাও বলেন। এ নিয়ে ৩০শে জুনের পর কাজ শুরু করার ঘোষণাও দেন তিনি। তিনি মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বাজেট বাস্তবায়নের উপরেও জোর দেন। বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলো স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। আমরাও সে রকম করা যায় কিনা ভেবে দেখছি। অর্থমন্ত্রী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে বাজেট পেশ প্রসঙ্গে বলেন, সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এখন অনেকটা সংস্কৃতিকে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের দিন বদলের ঘোষণার সঙ্গে মেলে না। তিনি বলেন, অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত সংসদের স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের নাম উল্লেখ করে বলেন, একদিনের বাদশাহ হয়ে তিনি এ সমস্যা তৈরি করেছেন। উনিই সব অনর্থের মূল। আমরা গত সংসদে ৬২ সিটের হিসাবে আমাদের প্রথম সারিতে ৬টা সিট দিয়েছিল। আমরা ওই তুলনায় অনেক বেশি ৫টি দিয়েছি। তিনি বলেন, তাদের অনুপস্থিতিতে দেশে অস্থিতিশীলতার কোন ইঙ্গিত নেই। তবে তারা সংসদে এলে ভাল হতো। তাদের অবস্থানটা এত কঠিন না হলে ভাল হতো। বাজেট পেশ করার আগে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল।
ফাঁস আমার জন্য হয়েছে - বাজেট ফাঁসকে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে তুলনা করে অর্থমন্ত্রীকে জড়িয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা আমার জন্যই হয়েছে। কিছু কিছু নীতি ফিডব্যাক পাওয়ার জন্যই আমি বলেছি। অনেক সময় মিডিয়ার চাপের মুখে বলেছি। যেমন বিলাসবহুল দ্রব্য, স্বাস্থ্যহানিকর পণ্যের কর বাড়ানোর কথা বলেছি। ব্যবসায়ীরা ওই ইঙ্গিত পেয়ে সুযোগ নিয়েছে। তবে কারও সঙ্গে গোপন সমঝোতার কথা ঠিক নয়। গত ১০ দিনে আমি বাইরের কোন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করিনি। এ ব্যাপারে আমি কঠোর গোপনীয়তা রাখার চেষ্টা করেছি। তবে দুঃশাসন কি পর্যায়ে গেছে, তার একটি উদাহরণ দেই। ৮ তারিখে আমি আমার সচিবকে একটি নোট দিয়েছিলাম। ১৫ দিন পর ওই নোটের সব কথা বেরিয়ে যায়। এই নিয়ে আমি তদন্ত করে দেখি পিয়নরা এসব গোপনীয় নোট বিক্রি করেন। এর সংস্কার কিভাবে করবো সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। ভবিষ্যতে বাজেট তৈরিতে একটি দল গঠনের কথা ভাবছি। যাদের কাছে মিডিয়া বা আপনাদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হয়নি - অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সম্পদ আহরণের হিসেবে বর্তমান বাজেটে শুল্ক কর বাড়ছে না। এ বাজেটে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। যাতে তারা বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে টিকে থাকতে পারে। আর প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। ধনী গাড়িওয়ালা ব্যবসায়ীদের বিলাসদ্রব্য বাড়ানো হয়েছে মূল্যসংযোজন কর। সাধারণ মানুষের ওপর কোন করের বোঝা চাপানো হয়নি। আমি আত্মবিশ্বাসী এবারের বাজেট থেকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে। তিনি সিপিডি'র এক বিশ্লেষণের জবাবে বলেন, আমরা সাধারণত বিনিয়োগ প্রক্ষেপণ করি একটি। সেটি হলো নিম্নতম। তবে তিন ধরনের প্রক্ষেপণ হওয়া উচিত। উচ্চতম, মাঝারি ও নিম্নতম। সামনের বছর থেকে আমরা দু'টি প্রক্ষেপণ দেয়ার চেষ্টা করবো। তিনি বর্তমান বাজেট উচ্চাভিলাষীর বদলে বাস্তবসম্মত বলে সিপিডি'র বিশ্লেষণকে স্বাগত জানান। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বাজেট বক্তব্যে মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৬ উল্ল্লেখ করেছি। কারণ বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে আমাদের বছরে প্রথম অংশটা ভাল কাটলেও পরের অংশটা কেমন কাটবে তা অনিশ্চিত। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী বছরের শুরুতে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব কাটলে অবস্থা আরও ভাল হবে। তিনি ছয় মাসে একবার আর্থিক বিবৃতি দেয়ার কথাও জানান। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। এছাড়াও সম্মেলন স্থলে উপস্থিত ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ, বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ.ফ.ম রুহুল হক, যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
No comments:
Post a Comment