June 6, 2009

ভুল সবই ভুল

বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ঘটনাচক্রে এসেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ক্ষমতার সিংহাসনে বসেছেন তিনবার। মাঝখানে জেলও খেটেছেন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে। পরে অবশ্য দুদক বলেছে, ব্যক্তিগত দুনর্ীতির খতিয়ান তারা পায়নি। তবে দলের নেতারা দুর্নীতিতে ডুবে ছিলেন এটা আর কোন ঘটনা নয়। তদারকি সরকার দুর্নীতির অভিযোগে তার দলকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। ওয়ান ইলেভেন বিএনপি জমানার সীমাহীন দুর্নীতি আর অপশাসনের কারণে এসেছিল তা-ই বলে গেছেন এর নায়কেরা। যদিও এই নায়কদের এখন আর কেউই ক্ষমতার ধারে কাছেও নেই। সরকার প্রধান হয়েছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। খালেদা জিয়া তাকে অনেক ভালবেসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বানিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের এই চাকুরে মার্কিন পাসপোর্ট নিয়ে রেখেছিলেন অনেক আগেই। তথ্য গোপন করে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের শরণাপন্ন হয়েছিলেন একটি চাকরির জন্য। এক সকালে সাইফুর রহমান তার ফাইল নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। খালেদাকে বোঝান- ফখরুদ্দীনকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হলে ক্ষতির চেয়ে হবে লাভ বেশি। এক দিকে দক্ষ অন্য দিকে বিশ্বব্যাংকও খুশি হবে। খালেদা রাজি হয়ে যান। এক সপ্তাহের মধ্যেই ফখরুদ্দীন ঢাকায় এসে দায়িত্বভার বুঝে নেন। সময় দ্রুত বয়ে যায়। একদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে গেল। আবার ধরনা, নতুন চাকরি চাই। খালেদার দক্ষ অর্থমন্ত্রী তাকে পিকেএসএফ-এর এমডির চাকরি দিয়ে আবার পুরস্কৃত করলেন। কে জানতো এই ফখরুদ্দীনই একদিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পেঁৗছে যাবেন জাদুর পরশে। অনেক নাটকীয়তা পর্দার আড়ালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য মরিয়া। সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে এই পদে বসানোর জন্য কিচেন কেবিনেটের পরামর্শে তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিচারপতিদের বয়সই বাড়িয়ে দিলেন। বিরোধীরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। জনমত তৈরি হলো এর বিরম্নদ্ধে। অথচ সমালোচকরাও বলেন, এমন একজন যোগ্য ব্যক্তিকে এভাবে বিতর্কিত করার কোন প্রয়োজন ছিল না। দলীয় অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন কেএম হাসান। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সংবিধানের বিকল্প ধারাগুলো আমলে না নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দায়িত্ব দেয়ার পেছনে ভূমিকা রাখলেন খালেদা নিজেই। যুক্তি একটাই, তিনি দলের প্রতি অনুগত থাকবেন। ইয়াজউদ্দিনের নিয়োগও ছিল সে রকমই। অত্যন্ত স্মার্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সরানোর জন্য কত কাহিনী তৈরি করা হলো। অথচ এই ভদ্রলোকের বাড়িতেই বিএনপি'র জন্ম হয়েছিল। বদরুদ্দোজা বিদায় নিলেন। কে হবেন পরবতর্ী প্রেসিডেন্ট। খালেদার টেবিলে অনেক নাম, অনেক প্রসত্দাব। একদিকে ইয়াজউদ্দিন অন্যদিকে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া। ঢাকার একটি দৈনিক খবর দিয়ে বসলো অধ্যাপক মিয়া নামাজ রোজা করেন না। তিনি একজন নাস্তিক। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একান্ত ইচ্ছায় খালেদা জিয়া তার ব্যক্তিগত সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালুকে পাঠালেন ইয়াজউদ্দিনের কাছে। ডেকে নিয়ে এসে যখন বলা হলো তাকে প্রেসিডেন্ট করার ইচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ডের। তখন তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেন। সংশ্লিষ্টদের মুখে এ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। খালেদার ইচ্ছে বাস্তবায়ন না হয়ে পারেনি। ইয়াজউদ্দিন প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সময় তাকে ইয়েসউদ্দিনও বলেছিলেন। যথার্থই ছিল তার মন্তব্য আখেরে তাই প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন হবে কিনা, হলে কিভাবে হবে এ নিয়ে টানটান উত্তেজনা চারদিকে। বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী বিদেশী বন্ধুরাও সরব হলেন। নির্বাচন হতে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গড়ে। সে চেষ্টায় বাদ সাধলেন ড. ইয়াজউদ্দিন। পর্দার আড়ালের ইশারায় সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। অস্থিরতা বাড়লো। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো উপদেষ্টাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে। উপদেষ্টাদেরকে ইয়াজউদ্দিন জানিয়ে ছিলেন এতে প্রশাসন কোন হস্তক্ষেপ করবে না। তিন ঘণ্টা পর নিজেই সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে এরশাদ অযোগ্য হয়ে গেলেন। শেখ হাসিনা নির্বাচনী কাফেলায় যোগ দিয়েও অনেকটা নাটকীয়ভাবে সরে দাঁড়ালেন। নির্বাচন পড়লো অনিশ্চয়তায়। সেনাবাহিনীকেও এ সময় বিতর্কিত করা হয় নানা কৌশলে। এর মধ্যেই ওয়ান ইলেভেনের আয়োজন সম্পন্ন হয়। নেপথ্যের আয়োজকরা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও টালমাটাল করে দিলেন। সবই যেন এক ছকে বাঁধা। জনগণ বিকল্প চিনন্তা করতে থাকলো। গণতন্ত্রের প্রতি সাময়িক কালের জন্য হলেও আস্থা হারালো। সুশীল সমাজের তিন প্রতিনিধি ছুটে গেলেন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের কাছে তদারকি প্রশাসনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য। তিনি তাদের ফিরিয়ে দেন নানা যুক্তি দেখিয়ে। এর মধ্যেই ঘটে যায় ওয়ান ইলেভেন। কিন্তু কে হবেন তদারকি প্রশাসনের প্রধান। সেদিন মাঝরাতে প্রফেসর ইউনূসের বাসায় হাজির হন তিন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। ইউনূস তাদের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন। তবে পরামর্শ দেন তার বন্ধু ড. ফখরুদ্দীনকে বানানোর জন্য। ওয়ান ইলেভেনের নায়কদের সামনে বিকল্প নেই। রাত দুটার সময় ড. ফখরুদ্দীন সম্মতি দিলে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়। ১২ই জানুয়ারি শপথ অনুষ্ঠান। দুই নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। শেখ হাসিনা দাওয়াত কবুল করলেন। বললেন, এই সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। তাই বঙ্গভবনে যেতে হবে। খালেদা মনঃস্থির করতে পারছিলেন না শপথে যাবেন কি যাবেন না। এই যখন অবস্থা তখনই এক সম্পাদক তাকে ফোনে বললেন, ম্যাডাম আপনি ওখানে যাবেন না। এটা আপনার বিরুদ্ধেই এক অঘোষিত সামরিক শাসন। খালেদা হুট করে সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। এর মধ্যে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য তার অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা রওনা হয়ে গেছেন। শিল্প ব্যাংকের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পর খালেদা নিজেই ফোন করেন সাইফুর রহমানকে। বললেন, অনেক তো বঙ্গভবনে গেছেন। আজ নাই গেলেন। সুচতুর সাইফুরকে বুঝতে দেরি হলো না। অর্থাৎ খালেদা চান বঙ্গভবনে না যেতে। সাইফুর রহমান ফিরে যান তার গুলশানস্থ জালালাবাদ হাউসে। ড. ফখরুদ্দীন-এর টেনশন বেড়েই চলেছে। হাজার হলেও তো কৃতজ্ঞতাবোধ! দূত মারফত নিশ্চিত হলেন, খালেদা যাবেন না তার শপথ অনুষ্ঠানে। ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। এর পরের ঘটনা সবার জানা। মার্কিন মুল্লুকে যার তিনটি বাড়ি, ভিন দেশের নাগরিকত্ব লাভকারী ব্যক্তি ফখরুদ্দীন রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেলেন। কেউ একটা প্রশ্নও তুললো না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এখন তার ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এক বছরের জন্য এসএসএফ সুবিধা কম ছিল কি? কিন্তু গোলমাল অন্যখানে। তদারকি প্রশাসন যখন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির হিসাব নিয়ে ব্যস্ত তখন সেনা শাসকেরা চেয়েছিলেন অন্তত উপদেষ্টাদের সম্পত্তির হিসাব প্রকাশ করা হোক। কিন্তু এতে ঘোরতর আপত্তি জানান ড. ফখরুদ্দীন। এখন বোঝা যাচ্ছে তিনি কেন এর বিরোধী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি বাড়ি যার, তার পক্ষে তো হিসাব দেয়া এক ধরনের তামাশা। ড. ইয়াজউদ্দিন মুখ খুলতে গিয়েও খুললেন না। একটি টেলিভিশন নেটওয়ার্ককে তিনি বললেন, খালেদা-হাসিনাকে তার নির্দেশেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তার স্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, সরি, ইয়াজউদ্দিন ভারসাম্য হারিয়ে এসব বলেছেন এটা তার মনের কথা নয়। সমালোচকরা এটাকে সহজে নেননি। ইয়াজউদ্দিন টিভিতে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? তিনি তো একদম মুক্ত মানুষ নন। তাকে এখনো নিরাপত্তা কমর্ীরা পাহারা দেয়। তাছাড়া তার সুযোগ্য স্ত্রীকে নিয়েইতো তিনি এসেছিলেন টিভিতে কথা বলতে। নিজের ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি মজা পেতে পারেন। কিন্তু পেছনে অনেকেই এর তাৎপর্য খুঁজে বেড়ান। কিভাবে ওয়ান ইলেভেনের দলিলে সই করেছিলেন এটা এখন অতীত। জাতির উদ্দেশে তার ভাষণ যিনি লিখেছিলেন তিনিও ছিলেন খালেদার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। আর অন্তত চারজনকে ডিঙ্গিয়ে ওয়ান ইলেভেনের নায়ক জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। মেজর জেনারেল রেজাকুল হায়দারকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে আদেশও জারি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে সাঈদ এস্কান্দারের চাপাচাপিতে খালেদা সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর এস্কান্দারই পর্দার আড়ালে থেকে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেনাবাহিনী কখনোই বাইরের হস্তক্ষেপমুক্ত অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখনও সে অবস্থার অবসান হয়নি। খালেদা জিয়া যখন জেলে তখন তার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলতে গেছেন জেনারেল এটিএম আমিন। সেনাপ্রধান মইন কখনও যাননি। যদিও খালেদার একান্ত ইচ্ছা ছিল তার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু জেনারেল মইন কেন জানি খালেদার সঙ্গে কথা বলতে চাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরে যে মানুষটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি হচ্ছেন জেনারেল আমিন। অতি সমপ্রতি তিনি চাকরি হারিয়েছেন অন্য অভিযোগে। আত্মীয়তার সুবাদে মেজর জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরীকেও খালেদা জিয়া নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি করেছিলেন। আর এই ভদ্রলোকই ছিলেন ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম রূপকার। জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীকেও খালেদা তার পছন্দের লোক হিসেবেই সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছিলেন। যাকে আওয়ামী প্রশাসন সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিল। ক্ষমতা পেয়েই খালেদা তাকে ডেকে নিয়ে এসে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেন। যিনি দুদকের চেয়ারম্যান হয়ে খালেদা এবং তার পরিবারকে দুনর্ীতির কালো কালিতে নাম লিখিয়ে রীতিমতো উল্লাস করে গেছেন। রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যুগে যুগে দেশে দেশে এমনটাই হয়েছে। দূর প্রতিবেশী পাকিস্তানে কি হয়েছিল? জুলফিকার আলী ভুট্টো এগারো জন জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। আর এই জিয়াউল হকই তার প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর মৃতু্য পরোয়ানায় সই করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিলেন।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor