ঘূর্ণিঝড় আইলা'র তাণ্ডবে উপকূল জুড়ে এখন কান্না আর হাহাকার। স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে লণ্ডভণ্ড দৰিণাঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম। উপকূলীয় ১১ জেলার ৭৪ উপজেলাই এখন যেন একটি শোকার্ত উপত্যকা। সরকারি হিসাবে আইলা'র ছোবলে ৯১ জনের মৃতু্যর কথা বলা হলেও আমাদের প্রতিনিধিরা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৩৪ জনের মৃতু্যর কথা জানিয়েছেন। তবে প্রতি ঘণ্টাতেই বাড়ছে এ সংখ্যা। রাতের আতঙ্ক শেষ হলেও উপকূলীয় জনপদে এখন নিখোঁজ স্বজনের জন্য উৎকণ্ঠা। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন হাজারো মানুষ। দক্ষিণাঞ্চলের মওসুমি ফসল, পানের বরজ ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে শ' শ' চিংড়ির ঘের। বেড়ি বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়া পানিতে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের লাখো মানুষ পানিবন্দি। বেশির ভাগ জায়গা এখনও তলিয়ে রয়েছে কয়েক ফুট পানির নিচে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নেমেছে নৌবাহিনীও। গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা জানিয়ে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে সেনাবাহিনী সদস্যরা ইতিমধ্যেই ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। নিখোঁজদের সন্ধানে পুলিশ, কোস্টগার্ড, সেনা ও নৌবাহিনীসহ স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী দলগুলো কাজ শুরু করলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর উত্তাল সাগর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সংস্থা উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে। দুর্গত এলাকায় এখন সবচেয়ে বেশি সঙ্কট বিশুদ্ধ খাবার পানির। আইলা'র তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরায়। সেখানে ৩২ জনের মৃতু্য নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন। ধবংস হয়ে গেছে ৫০ হাজার ঘরবাড়ি, ভেসে গেছে পাঁচ হাজার চিংড়িঘের। খুলনায় ২৫ জন, নোয়াখালীতে ২৫ জন, ভোলায় ১২ জন, বরিশালে ১০ জন, পটুয়াখালীতে ৬ জন, বাগেরহাটের শরণখোলায় দু'জন, পিরোজপুরে দু'জন, কক্সবাজারে দু'জন, নরসিংদীতে তিন জন, চাঁপাই নবাবগঞ্জে দু'জন ও নওগাঁয় দু'জনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে অনেক এলাকায় সড়ক ও নৌযোগাযোগ। এদিকে ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার একাধিক পয়েন্ট বেড়ি বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের কাছে কয়েকটি ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। আইলা'র প্রভাবে মেঘনার নরসিংদী এলাকায় ট্রলার ডুবিতে তিনজনের মৃতু্য ও পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলো বিপদ সংকেত ছয় থেকে নামিয়ে তিন করা হয়েছে। খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ে ৫৪টি উপজেলার ৬৮টি গ্রামের পাঁচ হাজার ৯০টি পরিবারের ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪২৯জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের গাগরিয়া, বাকেরগঞ্জের চর লক্ষ্মীবর্ধন, নোয়াখালীর নিঝুমদ্বীপ, হাতিয়ার বন্দরটিলা, নামারবাজার, বয়ারচর, কক্সবাজার সদর, ভোলার মনপুরা উপজেলার কলাতলী, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর গলাচিপার চিংগুড়িয়া, বাউফল, হোসনাবাদ, চাঁপাই নবাবগঞ্জের নাচোল, নরসিংদীর দত্তপাড়া বুধিয়া ঘাট এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে সোমবার সকালে বন্ধ করে দেয়া মংলা সমুদ্রবন্দর গতকাল সকালে আবার চালু করা হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আইলা সোমবার দুপুরে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। রাতে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। গতকাল সকালে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সাতক্ষীরা ও খুলনায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নৌবাহিনীর ২০ জাহাজ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় 'আইলা'-র প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছে সেনা ও নৌবাহিনী। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)-এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সাতৰীরা জেলার নীলডুমুর, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা; পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, কলাপাড়া, বাউফল, মির্জাগঞ্জ ও পটুয়াখালী সদর উপজেলা; খুলনার ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার ঘূর্ণিদুর্গত প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারি নির্দেশে সেনা সদস্যরা ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। দুর্গত এলাকায় তারা যেসব জরুরি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন তার মধ্যে আছে চাল, ডাল, চিড়া, গুড়, বিস্কুট, লবণ, খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, দিয়াশলাই ও মোমবাতি। এছাড়া দুর্গতদের আশ্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক তাবুও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০টি নৌযান নিয়োগসহ দুর্গত এলাকায় ইতিমধ্যে ৪টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। একই সঙ্গে একটি ভ্রাম্যমান হাসপাতালও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খাবার পানির সঙ্কট মোকাবেলায় ৪টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ওদিকে নৌবাহিনীর জাহাজ শহীদ ফরিদ ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রাথমিকভাবে বিতরণের জন্য চিড়া, গুড়, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওষুধ ও স্যালাইন নিয়ে বাগেরহাটের নলিয়ান এলাকায় গেছে। বানৌজা তিস্তা ত্রাণ ও উদ্ধার সরঞ্জামাদি নিয়ে বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। অন্যদিকে বানৌজা শহীদ দৌলত চরফ্যাশনে এবং নৌবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্ট বরগুনা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। বাগেরহাটের রামপাল থানার হাতালবুনিয়া ও জয়মনির গোল এবং খুলনার কয়রা এলাকায় নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিনটি ল্যান্ডিং ক্রাফট উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও খুলনাস্থ বানৌজা তিতুমীর হতে দু'টি ট্রাকযোগে নৌবাহিনীর ২৪ জনের একটি কন্টিনজেন্ট সাতক্ষীরার আশাশুনি ও গাবুরা এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও উদ্ধার সরঞ্জামাদি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরপরই ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে চট্টগ্রাম হতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ সৈকত উপকূলীয় অঞ্চলে ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার উদ্দেশে নিয়োজিত হয়েছে। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় নৌবাহিনীর উদ্ধারকাজ খুলনা নৌ অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার কমডোর কমান্ডিং খুলনার তত্ত্বাবধানে এবং দেশের উপকূলবতর্ী অন্যান্য অঞ্চলসহ সমুদ্র এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার কমডোর কমান্ডিং চট্টগ্রাম ও কমডোর কমান্ডিং বিএন ফ্লোটিলার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
May 27, 2009
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Thanks
ReplyDeleteaR
Bangla Blog Tips