September 14, 2013

নবাবের চির প্রস্থান

খান আতা’র ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটির মাধ্যমে কিংবদন্তি হয়ে ছিলেন আমৃত্যু। তাকে বলা হয় বাংলার মুকুটবিহীন নবাব। নানামুখী চরিত্রে তার অভিনয় সমৃদ্ধ করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকে। তিনি অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। সবার শ্রদ্ধার, সবার প্রিয় আনু ভাই অর্ধশতকেরও বেশি সময় বাংলা চলচ্চিত্রে সরব পদচারণার পর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে জীবনের যবনিকা টেনেছেন। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এ কিংবদন্তী অভিনেতার (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার  বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আনোয়ার হোসেন অসুস্থতা নিয়ে গত ১৮ই আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। এক সপ্তাহ পর চিকিৎসকরা জানান, তেমন বড় কোন সমস্যা নয়। সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন তিনি ওই সপ্তাহেই। বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় তার পিত্তথলিতে পাথর থাকার বিষয়টি সন্দেহ করছিলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছিলেন, অস্ত্রোপচারের মতো শারীরিক অবস্থা না থাকায় এভাবেই থাকতে হবে তাকে। একপর্যায়ে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এ অভিনেতার উন্নত চিকিৎসায় দায়িত্ব নিয়েছিল সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিনেতার সুচিকিৎসার তদারকি করেছেন। বৃহস্পতিবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে গিয়ে তিনি চিকিৎসার জন্য তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে ১০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন। এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তাকে এক লাখ টাকা সহায়তা দেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি তাকে দেখতে গিয়ে বিদেশে চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয় এই অভিনেতাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন স্ত্রী নাছিমা খানম, চার ছেলে ও এক মেয়ে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহীকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। তার চার ছেলের মধ্যে  বড় ছেলে  থাকেন সুইডেনে। অন্য তিন ছেলে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। এই গুণীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে গোটা দেশ।
এক জীবনে আনোয়ার হোসেন
আনোয়ার  হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ই নভেম্বর জামালপুরের সরুলিয়া গ্রামে। পিতা নাজির হোসেন ছিলেন জামালপুরের সাবরেজিস্ট্রার। শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বেশ ক’বছর কেটেছে তার জামালপুরে। ১৯৫১ সালে জামালপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ময়মনসিংহ ছেড়ে এক সময় ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা বেতারের নাটকে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৫৭ সালে। নাটকটির নাম ছিল ‘নওফেল হাতেম’। আনোয়ার হোসেন অভিনীত প্রথম ছবি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ ছবিটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৪ সালের ১লা মে ‘দুই দিগন্ত’ ছবিটি দিয়ে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহের শুভ উদ্বোধন হয়েছিল। আনোয়ার হোসেনের অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে নবাব সিরাজদ্দৌলার পর জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ উল্লেখ্যযোগ্য। রাজেন তরফদার পরিচালিত ‘পালঙ্ক’ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। তার অসাধারণ অভিনয় দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আনোয়ার হোসেন একজন বহুমাত্রিক অভিনেতা হিসেবে প্রায় চারশত ছবিতে অভিনয় করেন। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র শিল্প একজন কিংবদন্তি অভিনেতার পাশাপাশি একজন অভিভাবককেও হারালো।

অর্জিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
আনোয়ার হোসেন
১৯৭৫ সালে প্রথম প্রবর্তিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ছবিগুলো হচ্ছে- গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), দায়ী কে (১৯৮৭) এবং লালসালু (২০০১)। এছাড়াও বাংলাভাষার প্রথম ডিজিটাল স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আই ২০০৯ সালে দ্বিতীয় ‘চ্যানেল আই’ চলচ্চিত্র মেলায় আনোয়ার হোসেনকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। সর্বশেষ ২০১০ সালে আনোয়ার হোসেনকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বিভিন্ন সংগঠনের শোক
আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বিএফডিসি), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা, ফিল্ম এডিটর গিল্ড, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি সিডাব, বুকিং এজেন্ট সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, ফিল্ম জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor