April 6, 2011

ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক এবং তিন সত্য


ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: প্রচলিত এটি কথা আছে সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। কিন্তু আসলেই সত্যটা কি? গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়েও ৩ সত্য বিষয় আছে। আর তা হলো- আইনি সত্য, রাজনৈতিক সত্য এবং নৈতিক সত্য। এ বিষয়ে আদালতের রায়ের মাধ্যমে আইনি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে আইনি সত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারি রিভিউ কমিটির কার্যক্রম এখনও অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। আরও একটি বিষয় হলো- রাজনৈতিক সত্য। সেটি বিবেচনা করতে হলে আগে দেখতে হবে ড. ইউনূসের অপসারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে কার লাভ বা লোকসান হলো। তারা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কি ধরনের রাজনৈতিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আর নৈতিক সত্যের বিষয়ে দেখতে এখানে নৈতিকভাবে কার জয় এবং কার পরাজয় হয়েছে। কারণ বিষয়টির শুরু থেকেই অনেকের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। ড. ইউনূস আগে উন্নয়ন উদ্যোক্তা হিসেবে সারা বিশ্বে সমাদৃত ছিলেন। এখন হয়তো উন্নয়ন শহীদ হিসেবে বিবেচিত হবেন। এভাবে একজন ত্যাগী মানুষকে ছোট করলে সত্য কার পক্ষে যাবে?

গ্রামীণ ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কেন গড়ে ওঠে? যেটি শুধু আমাদের দেশে সম্ভব হয়েছে। অন্য দেশে তা কিন্তু হয়নি। আমাদের দেশে এসব উন্নয়ন সংস্থা যাদের ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। অথচ এই কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব ছিল কিন্তু সরকারের। সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থ বা অপারগ হওয়ায় এই দায়িত্বটুকু পালন করেছে এসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। তারা সেই ঘাটতিটি পূরণ করেছে। আর একটি দিক হলো- কর্মসংস্থানের জন্য বাজার ব্যবস্থার একটি ভূমিকা আছে। আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই বাজার ব্যবস্থার যে ভূমিকা থাকার কথা ছিল সেটিও সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে যদি থামিয়ে দেয়া হয় তাহলে সরকারের অসম্পূর্ণতা ও বাজারের ব্যর্থতা আরও বিস্তৃত হবে।

ব্যাংক পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আস্থা। ঋণ পরিশোধে যাতে কোন ধরনের ব্যত্যয় না ঘটে, গ্রাহকরা যাতে তাদের গচ্ছিত আমানত ঝুঁকিপূর্ণ মনে না করেন- এ বিষয়টিও ভাবতে হবে। আর যারা জামানত রাখেন তাদের আস্থা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক যাতে কোনভাবে তারল্য সঙ্কটে না ভোগে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূস কেন্দ্রে আছেন। এখানে ব্যাংকের আরও অনেক আছেন যারা ব্যাংক পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি নিজেরা আবার কোন সিদ্ধান্ত নেন তাহলে অন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।

গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা করে। সরকারও ক্ষুদ্র ঋণ দেয়। সরকারের অর্ধডজন মন্ত্রণালয় আছে যারা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সরকারের এই ঋণ কার্যক্রমের লক্ষ্য যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয় তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্টো ফল আনতে পারে। বিষয়টি একটি বৈরী অবস্থার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো। যদিও সমাধানের আরও কিছু প্রক্রিয়া এখনও বাকি আছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে তা জাতির জন্য কোন উপকারী কিছু হয়নি। দেশের ভাবমূর্তির জন্য বিষয়টি ভাল হয়নি। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা হলো যে ড. ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তির যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ রাম শ্যাম যদু মধুদের অবস্থা কি হবে? আমরা দেখলাম গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির যুগেও সরকার এখনও কত ক্ষমতাবান। এটা আমাদের রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকদের মনে পুনর্ভাবনার জন্ম দেয়।

ড. ইউনূসের বিষয়টি এখন সরকারের হাতে। যদিও আইনের বাতাবরণে অনেকটা রাজনীতি খেলা করছে। এতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো- প্রতিষ্ঠানটি যেন আস্থার সঙ্কটে না পড়ে, অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়ে। পরবর্তী পদক্ষেপগুলো যেন মসৃণ হয়। নিয়ম অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও সহৃদয়তার সঙ্গে করা হয়। যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন এই প্রতিষ্ঠানের ২৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনোভাবের প্রতি যেন শ্রদ্ধা জানানো হয়। সব বিজয়ের মধ্যেও মহানুভবতা থাকা উচিত। সরকারের জন্য সে সুযোগটি এখনও আছে।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor