
বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম। অবস্থার অবনতি ঘটলে কয়েকদিন আগে তাকে সিলেটের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার দুপুর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে তার ছেলে শাহ নূর জালাল জানান। তাকে চিকিৎসাসেবা দেয়া ডা. সুজন বোস জানান, সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে মারা যান আবদুল করিম। দুপুর ১টার দিকে তার মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হলে মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, সিলেটের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার ফজলুর রহমান, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিছাবহ উদ্দিন সিরাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ন ম শফিকুল হক, গণতন্ত্রী পার্টির জেলা সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী, ন্যাপ সভাপতি সৈয়দ আবদুল হান্নান, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি বেদানন্দ ভট্টাচার্য, জাসদ সেক্রেটারি লোকমান আহমদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শহীদুল আলম, বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল খালিক মায়ন, সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী নেতারা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। দুপুর ২টার পর হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন দরগা মসজিদের ইমাম হাফিজ আসাদ আহমদ।
এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের পক্ষ থেকেও তার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী প্রয়াতের ছেলে নূর জালালের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন এবং তাকে সমবেদনা জানান। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীও প্রয়াতের ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে তাকে সমবেদনা জানিয়েছেন।
তার মুত্যুতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি শোক বই খোলা হয়েছে। তার লাশ সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতালের মরচুয়ারিতে রাখা হয়। আজ রোববার সকালে তার দ্বিতীয় জানাজা দিরাই উপজেলা সদরে এবং বাদ জোহর তৃতীয় জানাজা উজানধলে নিজ গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে। পরে স্ত্রী সরলার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।
ছোটবেলা থেকে আবদুল করিম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের পাঠশালা বিদ্যালয়ে মাত্র ৮ দিন শিক্ষা নেন তিনি। এরপর যা শিখেছেন তা শুধু নিজ চেষ্টায়। দারিদ্র্যে মাধ্যমে কঠোর পরিশ্রমে বেড়ে ওঠেন তিনি। শৈশব থেকে তার নিত্যসঙ্গী ছিল একতারা। সঙ্গীতের প্রতি তিনি এতই অনুরাগী ছিলেন যে, তা ছেড়ে তিনি কোন চাকরিতে যোগ দেননি। ফলে দারিদ্র্য কখনও তার পিছু ছাড়েনি। কিন্তু তাতে কি; সঙ্গীতের ফাঁকে কৃষিকাজে নিয়োজিত করেন নিজেকে। অত্যন্ত সাদাসিদেভাবে তার জীবন কাটলেও কেউ তাকে কোন প্রলোভনে আকৃষ্ট করে দূরে সরাতে পারেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাউল করিম তার আধ্যাত্মিক গানের তালিম নেয়া শুরু করেন কমর উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহীম মোস্তান বকশের কাছ থেকে। কালজয়ী এ বাউল সম্রাটের দীর্ঘ জীবনে প্রায় ১৬শ' গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। যেগুলো ছয়টি বইয়ে গ্রন্থিত আছে। তার উল্লেখযোগ্য অসংখ্য গান রয়েছে। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০টি গান অনূদিত করা হয়েছে। বাউল সম্রাটের গান ভাষা আন্দোলনসহ মুক্তিদ্ধুদ্ধে নানা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি ১৫ বছর বয়সের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার গানে ফুঠে উঠেছে গ্রাম্য কৃষক, মেহনতি মানুষের দুঃখদশা এবং সমাজে বিভেদের বিষয়টিও উঠে এসেছে। তার কালজয়ী গান অমর হয়ে আছে পৃথিবীর বুকে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হাওরবেষ্টিত উজানধল গ্রামে শাহ আবদুল করিম জন্মগ্রহণ করেন অতি সাধারণ এক দরিদ্র পরিবারে। তার বাবার নাম ইব্রাহিম আলী। মায়ের নাম নাইওরজান বিবি। স্ত্রী সরলার মৃত্যুর পর বাউল কবি অনেকটাই মুষড়ে পড়েন। ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে নিজ গ্রামে বাস করছেন। তার একমাত্র ছেলের নাম শাহ নূরজালাল।

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে প্রথম বই আফতাব সঙ্গীত বের হয়। গণসঙ্গীত ১৯৫৭, কালনীর ঢেউ ১৯৮১, ধলমেলা ১৯৯০, ভাটির চিঠি ১৯৯৮ ও কালনীর কূলে ২০০১ সালে বের হয়। চলতি বছরের মে মাসে তার রচনা সমগ্র বের করে সিলেটের খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট। ২০০১ সালে তাকে তার কালজয়ী সৃষ্টির স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক প্রদান করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ পদক, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৪ সালে মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, ২০০৫ সালে সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড, ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সম্মাননা, ২০০৬ সালে অভিমত সম্মাননা, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা, ২০০৮ সালে খান বাহাদুর এহিয়া এস্টেট সম্মাননাসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য সংবর্ধনা দেয়া হয় তাকে। এছাড়া তিনি ১৯৪৬, ১৯৮৫ ও ২০০৭ সালে বিলাত ভ্রমণ করেন।
সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারস্বপ্ন পূরণ হলো না
সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারলেন না বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। তার স্বপ্ন ছিল গ্রামের বাড়ি দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে বাড়ির আঙিনায় একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। যে গান শিখবে শিশুসহ সব বয়সীরা। শাহ আবদুল করিমের ইচ্ছা তার বাড়ির আঙিনায় সঙ্গীত বিদ্যালয় হোক; কিন্তু বার বার প্রশাসন অন্য স্থানে করতে চাওয়ায় তা ঝুলে যায়।
শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল জানান, বাবার স্বপ্ন ছিল সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই চলে গেলেন।' এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সামছুল ইসলাম জানান, এই বাউলের জন্য সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। জায়গা পেলে শিগগির এর কাজ শুরু করা হবে।
No comments:
Post a Comment