নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, গরিবের বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক পদক 'প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম' পাচ্ছেন হয়েছেন। এ বছর এ পদকে মনোনীত কৃতী ১৬ ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা নিজে আগামী ১২ই আগস্ট হোয়াইট হাউসে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গর্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ মনোনীতদের হাতে এ পদক তুলে দেবেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ড. ইউনূস বাংলাদেশকে ফের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরলেন। এ পদক পাওয়ার খবরে বিনয়ী ড. ইউনূস বলেছেন, এ সম্মান শুধু তার একার নয়। এ সম্মান পুরো বাংলাদেশের, বাংলাদেশীদের। এ বছর দি প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদকে মনোনীত বিশ্ব বরেণ্য ১৬ ব্যক্তির সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করে ওবামা বলেছেন, নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণমুখী নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অনুকরণীয় ভূমিকা রেখেছেন এসব প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি। তাদেরকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গৌরবের। এক প্রতিক্রিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা অনেক কঠিন স্তর পার হয়ে এসেছি। এখন কাজ হচ্ছে দ্রুততম সময়ে জনমানুষকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। মনে সাহস ও গন্তব্যে পেঁৗছার দৃঢ় মনোবল থাকলে সেটি করা সম্ভব- এটি মনে রাখা দরকার। তিনি বলেন, এ পথে বাধা এলে তা অতিক্রম করতে মনে সাহস থাকা দরকার। গতকাল সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস তার পদক পাওয়ার খবর দিয়ে আরও জানায়- যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থে, বিশ্ব শান্তি, সংস্কৃতি তথা সরকারি-বেসরকারি খাতে অসামান্য অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিদের এ পদকে ভূষিত করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সনদ প্রদানের ঘটনা এটাই প্রথম। তিনি এবার যাদের পুরস্কৃত করছেন তাদের কেউ ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা, কেউবা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত। কেউ লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক লোকজনের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান মেডেল অব ফ্রিডম চালু করেন। ১৯৬৩ সলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মানিত করতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এ পদক পুনঃপ্রবর্তন করেন। এ পদক যারা পান তারা সম্মানের পাত্র হলেও ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ এ পদক দেয়ায় তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক ওঠে। ওই সময় যাদেরকে পদক দেয়া হয় তাদের মধ্যে তার ইরাক নীতির কেন্দ্রে ছিলেন এমন তিনজন ব্যক্তি ছিলেন। তারা হলেন_ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সাবেক পরিচালক জর্জ টেনেট, যুক্তরাষ্ট্র নিয়োজিত ইরাকের সাবেক প্রশাসক এল. পল ব্রেমার এবং জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) টমি ফ্রাঙ্কস। এদের মধ্যে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা ও ইরাক যুদ্ধে গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য টেনেট ছিলেন সবচেয়ে বিতর্কিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে বারাক ওবামা নজির স্থাপন করছেন প্রকৃত সমাজ পরিবর্তনে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশের গর্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর একে একে অর্জন করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন সংগঠনের সম্মান-পদক। তার মধ্যে আছে কিংস আবদুল আজিজ মেডেল, র্যামন্ড ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ, সিডনি পিস প্রাইজ, ইকুয়েডোরিয়ান পিস প্রাইজ প্রভৃতি। এছাড়া তিনি পেয়েছেন ২৬টি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি এবং ১৫টি বিশেষ পুরস্কার। তার নোবেল পুরস্কার বিজয়ের সম্মানস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তন করেছে একটি স্মারক ডাকটিকেট। ২০০৮ সালে জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউসটন ১৪ই জানুয়ারিকে 'মুহাম্মদ ইউনূস দিবস' ঘোষণা করেছে। ২০০৮ সালের ২রা ডিসেম্বর তিনি অক্সফোর্ডে রেমেন্স লেকচার দিয়েছেন। পেয়েছেন আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালের ২১শে মে ফিলাডেলফিয়া তাকে দেয় ডোয়েট ডি. আইজেনহাওয়ার মেডেল। ২০০৭ সালের ১৪ই জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে নেলসন ম্যান্ডেলা, গ্রেসা মেসেল এবং ডেসমন্ড টিটু বিশ্বের প্রতিভাবান এবং স্বাধীন নেতাদের নিয়ে একটি সংগঠন আহবান করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা এর নাম দেন ডি গ্লোবাল এল্ডার্স। ওই সংগঠনে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে কফি আনান, জিমি কার্টার, মেরি রবিনসন-এর পাশাপাশি স্থান পায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। এবার যারা অনন্য এ পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন তাদের পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো-
১. ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক। দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। নিজ গ্রাম থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক।
২. ন্যান্সি ব্রিংকার। তিনি খ্যাতনামা ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক সংস্থা সুসান জি, কোমেন ফর কিউর-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮০ সালে ব্রেস্ট ক্যান্সারে বোনের মৃতু্যর পর সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিংকার।
৩. পেডরো জোসে গ্রের জুনিয়র। তিনি একজন চিকিৎসক ও ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন বিষয়ক একাডেমীর সহকারী ডীন। তিনি ক্যামিলাস হেলথ কনসার্ন-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠানটি মিয়ামিতে বছরে গৃহহীন ১০ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করে।
৪. স্টিফেন হকিংস। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থ ও গণিতবিদ। ৬৭ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী লন্ডনে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। কৃষ্ণ গহ্বর থিয়রির জন্য বিখ্যাত। কয়েক বছর ধরে তিনি প্রায় পঙ্গু জীবন যাপন করছেন।
৫. নিউ ইয়র্কের সাবেক রিপাবলিক্যান নেতা জ্যাক কেম্প, গত মে মাসে তিনি মারা যান। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলে তিনি গৃহায়ন ও শহর উন্নয়ন বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন।
৬. সিনেটর এডওয়ার্ড এম, কেনেডি। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কেনেডির ভূমিকা যথেষ্ট। মানবাধিকার উন্নয়ন বিষয়ক আইন প্রণয়নেও তার অবদান অনেক।
৭. বিলিয়ে জিয়ান কিং। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকের খ্যাতিমান টেনিস খেলোয়াড়।
৮. জোসেফ লরি। ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে মানবাধিকার আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন।
৯. জোয়ে মেডিসিন ক্রাউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জীবিত শেষ ভারতীয় যোদ্ধা।
১০. হারভে মিল্ক। প্রথম কোন সমকামী ব্যক্তিত্ব যিনি একজন নির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৭৭ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকো বোর্ড অব সুপারভাইজার কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচিত হন।
১১. সানড্রা ডে কোনর। যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮১ সালে তাকে মনোনীত করেন।
১২. সিডনে পইটিয়ার। খ্যাতিমান কৃষ্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তারকা। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনিই প্রথম আফ্রো-আমেরিকান যিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে একাডেমিক এওয়ার্ড লাভ করেন।
১৩. চিতা রিভেরা। জনপ্রিয় নায়ক, গায়ক, নৃত্যশিল্পী ও টনি এওয়ার্ডস বিজয়ী।
১৪. মেরি রবিনসন। আয়ারল্যান্ডের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। ৯০-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৫. জ্যানেট ড্যাভিশন রোলে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ও চিকিৎসক।
১৬. ডেসমন্ড টুটু। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সাবেক নেতা ও আর্চবিশপ। ১৯৮৪ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
No comments:
Post a Comment