October 10, 2011

লাশ ফেরত চান স্বজনরা

সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ হওয়া ফরিদপুরের মটরচর গ্রামের আবুল হোসেনের স্বজনদের আহাজারি।

এক মিসরীয়কে হত্যার দায়ে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ করা আটজনের পরিবারে শোকের মাতম চলছেই। তাদের পরিবারের সদস্যরা লাশ ফেরত চান। লাশ সৌদি আরবে দাফন হওয়ার খবরে তারা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তাদের প্রশ্ন, সন্তানের লাশ মা দেখতে পাবেন না, এটা কেমন বিচার! কবর থেকে লাশ উঠিয়ে দেশে আনার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা। শিরশ্ছেদ করা কয়েকজনের পরিবারের দাবি, তারা নির্দোষ। অন্যায়ভাবে তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে।

মতিয়ার রহমান : সৌদি আরবের রিয়াদে গত শুক্রবার প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করা আট বাংলাদেশির একজন ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের মতিয়ার রহমান। তার মা ও ভাইবোনেরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিচার যত কঠিনই হোক সন্তানের লাশ মা একটিবার দেখতে পাবেন না, এটা কেমন বিচার? কৃষ্ণনগর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে সারা গ্রাম নিশ্চুপ, নিঃস্তব্ধ। তাদের ধারণা ছিল, লাশ সৌদি সরকার বাংলাদেশে পাঠাবে। ছেলের শিরশ্ছেদের সংবাদ মা সুফিয়া বেগমকে জানানো হয় গতকাল রোববার। তিনি খবর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে তিনি শুধু বুকফাটা আর্তনাদ করে একটি কথাই বলতে থাকেন, 'আমার জাদুরে একবারের জন্য দেখতে দাও।' গতকাল সকাল থেকে বাড়িতে নামে শোকার্ত মানুষের ঢল।
আবুল হোসেন : ফরিদপুরের সদর উপজেলার মটরচর গ্রামের আহমেদ বিশ্বাসের ছেলে আবুল হোসেন ২০০৫ সালে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে ক্লিনারের কাজ করতেন। তার শিরশ্ছেদের রায় হয়েছে- এ খবর পেয়ে তার পরিবার সরকারের কাছে তার প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছিল। আবুল হোসেনের মা কমেলা খাতুনের দাবি, সরকার যেন তার ছেলের লাশ দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে শেষ দেখার সুযোগ দেয়।
সুমন : সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ হওয়া সুমনের টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়ার বাড়িতে রোববার সকালে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম। এলাকার লোকজন ভিড় করছে সুমনদের বাড়িতে। তার মা দেলেমন বেগম ছেলের ছবি হাতে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন; বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। সুমনের বাবা মিলন মিয়া তিন বছর ধরে সৌদি আরব থাকেন। ছেলের সঙ্গে তার একবারও দেখা হয়নি বলে পরিবারের লোকজন জানান। গ্রামের আবু মিয়া জানান, ১৬ বছর বয়সে সুমন বিদেশ যান। তিনি খুব ভালো ও শান্ত-শিষ্ট ছিলেন।
মামুন : টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আবদুল্লাহপাড়ার মামুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার মা হাজেরা খাতুন আহাজারি করছেন। মামুনের বড় ভাই হারুন মিয়া জানান, ভিটেমাটি বিক্রি করে আট বছর আগে মামুনকে বিদেশ পাঠান। তার এক বোন রয়েছে। হত্যা মামলার পর থেকেই মামুন জেলে ছিল। মামলা হওয়ার পর তারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করেছেন। তবে কোনো কাজ হয়নি। মামুনের লাশ যেন পান এ দাবি করেন তারা সরকারের কাছে।
মাসুদ : টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কস্তুরীপাড়া গ্রামে মাসুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার মা রোকেয়া বেগম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিবেশীরা তার শুশ্রূষা করছেন। পরিবারের সবাই কান্নাকাটি করছেন। মাসুদ চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। বোন জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়েছে। অন্য বোন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ভাই সুমন বাড়িতেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করে। বাবা শামছুল হক পুত্রশোকে কাতর। জ্যোৎস্না জানান, অপরাধের সঙ্গে আমার ভাই জড়িত ছিল না। বিনা দোষেই তার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। সরকারের কাছে দাবি, ভাইয়ের লাশ দেশে এনে পরিবারের কাছে যেন হস্তান্তর করা হয়।
শফিক আল ইসলাম : 'মাগো কত দিন হয় তোমাকে দেখি না। তোমার হাতের রান্না খাই না। তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। আমার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করো। তোমার দোয়ায় আমি ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসব।' শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে মা রওশনারার কাছে ফোন করে এভাবেই বাড়ি ফেরার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন শফিক। ওইদিনই সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ হওয়া শফিক আল ইসলাম ওরফে শফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়ার ভাতকুরাচালায় গতকাল রোববার গিয়ে দেখা যায় তার মা রওশনারা ছেলের ছবি বুকে নিয়ে এসব কথা বলে বিলাপ করছেন। ছেলে বাড়ি ফিরবে- এমন স্বপ্ন দেখার একদিন না যেতেই শনিবার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মায়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এ খবরে স্বজনদের বুকফাটা আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। গতকাল রোববারও শফিকুলের গ্রামের বাড়িতে ছিল স্বজনদের আহাজারি। শফিকুলের ৭০ বছরের মা রওশনারা যে কাউকে কাছে পেলেই চিৎকার করে বলছিলেন, 'তোমরা আমার সোনার বাবারে আইনা (এনে) দিবা কিনা কও। একবার বাবার লাশ দেখে মরবার চাই।' ৮০ বছরের বাবা খোয়াজউদ্দিন ছেলের এমন মৃত্যুর খবরে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তিনিও তার ছেলের লাশ ফিরে পাওয়ার দাবি জানান।
ফারুক : দাউদকান্দি উপজেলার পিপিয়াকান্দি গ্রামের কৃষক জামাল হোসেনের বড় ছেলে ফারুক। জামাল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ফারুক ২০০৪ সালে ১৫ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে এবং সুদে টাকা নিয়ে সৌদি আরব গিয়ে রিয়াদে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে যোগদান করে। বিদেশে যাওয়ার পর থেকে ফারুক মাত্র ৫০ হাজার টাকা পাঠায়। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ফারুকের বাবা জামাল হোসেন অবশিষ্ট জায়গা-জমি বিক্রি করে চার বছর মামলা পরিচালনার জন্য প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা সৌদিতে পাঠান। ফারুকের মা সাজেদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের পর ফারুকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে শেষ কথা হয়। ফারুক জানায়, 'মা আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।'
সুমন মিয়া : কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার কোমারপুর গ্রামে সুমন মিয়ার বাড়িতে গতকালও ছিল শোকের মাতম। সংসারের অভাব দূর করতে জমি বিক্রি করে সুমন গিয়েছিলেন সৌদি আরব। তার মৃত্যুতে পরিবারের লোকজন এখন দিশেহারা।

No comments:

Post a Comment

Khoj Khobor